প্লেনের নাক আবার সরল একটা কোর্স ধরতেই সে বুঝতে পারল, কোথাও কোনো গোলযোগ ঘটে গেছে। চার নম্বর ইঞ্জিনের আরপিএম নামছে, কেঁপে গেল ইয়াবারার গলা। ফুয়েলের অভাবে অচল হয়ে যাচ্ছে ওটা।
ইঞ্জিনটা তাহলে বন্ধ করে দেয়া উচিত নয়?
নিয়মটা আমার জানা নেই, শুকনো গলায় বলল ইয়াবারা।
হায় ঈশ্বর, কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে করল রুবিনের, এক অন্ধ আরেক অন্ধকে পথ দেখাচ্ছে। অলটিমিটারে দেখা গেল প্লেন আর সাগরের মাঝখানে দূরত্ব কমে আসছে দ্রুত। তারপর, হঠাৎ করে, কন্ট্রোল কলাম হাতের মুঠোর ভেতর নড়বড়ে হয়ে গেল, কাঁপতে লাগল থরথর করে।
প্লেন স্টল করছে! চেঁচিয়ে উঠল ইয়াবারা, এই প্রথম ভয় পেল সে। নাকটা নিচে নামান!
কন্ট্রোল কলাম সামনের দিকে ঠেলে দিল রুবিন, জানে অবধারিত মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করছে সে। ফ্ল্যাপ নামাও, ইয়াবারাকে নির্দেশ দিল।
ফ্ল্যাপস কামিং ডাউন, বলল ইয়াবারা।
বিড়বিড় করল, দিস ইজ ইট।
খোলা ককপিটের দরজায় একজন স্টুয়ার্ডের দাঁড়িয়ে রয়েছে, চোখ দুটো বিস্ফারিত চেহারা কাগজের মতো সাদা। জানতে চাইল, আমরা কি ক্র্যাশ করছি? কোনো রকমে শোনা গেল।
ব্যস্ত, তাকানোর সময় নেই, কর্কশকণ্ঠে বলল, হ্যাঁ, সিটে বসে বেল্ট বাঁধো যাও!
ঘুরে দাঁড়িয়ে ছুটল স্টুয়ার্ডেস, পর্দা সরিয়ে মেইন কেবিনে ঢোকার সময় হোঁচট খেল একবার। তার আতঙ্কিত চেহারা দেখে ফ্লাইট অ্যাটেনড্যান্ট আর প্যাসেঞ্জাররা বুঝল, উদ্ধার পাবার কোনো আশা নেই। আশ্চর্যই বলতে হবে, কেউ ফুঁপিয়ে বা চেঁচিয়ে উঠল না। লোকজন প্রার্থনাও করছে নিচু গলা।
ককপিট থেকে ঘাড় ফিরিয়ে মেইন কেবিনের দিকে তাকাল এডুরাডো ইয়াবারা। বৃদ্ধ এক লোক নিঃশব্দে কাঁদছে, তার গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিচ্ছেন হে’লা কামিল। মহাসচিবের চেহারা সম্পূর্ণ শান্ত। সত্যি আশ্চর্য এক মহিলা, ভাবল ইয়াবারা। দুঃখজনকই বটে যে তার সমস্ত সৌন্দর্য খানিক পরই নিঃশেষে মুছে যাবে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইনস্ট্রুমেন্ট প্যানেলের দিকে ফিরল সে।
দুশো মিটারের ঘর ছাড়িয়ে নেমে এসেছে অলটিমিটারের কাঁটা। বিরাট একটা ঝুঁকি নিয়ে অবশিষ্ট তিনটে ইঞ্জিনের ফুয়েল খরচ বাড়িয়ে দিল ইয়াবারা। বেপরোয়া একজন মানুষের অর্থহীন কাণ্ড। ইঞ্জিনগুলো এখন শেষ কয়েক গ্যালন ফুয়েল তাড়াতাড়ি পুড়িয়ে অচল হয়ে যাবে। আসলে ইয়াবারার চিন্তা-ভাবনায় এই মুহূর্তে যুক্তির কোনো অবদান নেই। কিছু না করে চুপচাপ বসে থাকতে পারছে না সে। একটা কিছু করার তাগাদা অনুভব করছিল সে, তাতে যদি তার নিজের মৃত্যু হয় তো হোক।
বিভীষিকাময় পাঁচটা মিনিট পেরিয়ে গেল যেন এক পলকে। প্লেনটাকে খামচে ধরার জন্য বিদ্যুৎ বেগে ওপর দিকে ছুটে এল কালো সাগর। আ-আলো! অবিশ্বাস আর উত্তেজনায় তোতলালো রুবিন। আমি আ-আলো দেখতে পাচ্ছি! নাক বরাবর সামনে!
উইন্ডশিন্ডের ভেতর থেকে হঠাৎ করেই ইয়াবারা দেখতে পেল সেই আলো। জাহাজ! চেঁচালো সে। একটা জাহাজ।
আর ঠিক সেই মুহূর্তে, আইসব্রেকার পোলার এক্সপ্লোরার-এর ওপর দিয়ে উড়ে গেল বোয়িং, দশ মিটারের জন্য রাডার মাস্টের সাথে ধাক্কা খেল না।
.
০৭.
রাডার আগেই সাবধান করে দিয়েছিল ক্রুদের, একটা প্লেন আসছে। ব্রিজে দাঁড়ানো লোকজন বোয়িংয়ের গর্জন শুনে নিজেদের অজান্তেই মাথা নামিয়ে আড়াল খুঁজল। জাহাজের মাস্তুল প্রায় ছুঁয়ে গ্রিনল্যান্ডের পশ্চিম উপকূলের দিকে ছুটে গেল প্লেনটা।
কমান্ডার বায়রন নাইটের সাথে ঝড়ের বেগে ব্রিজে ঢুকল পিট আর জিওর্দিনো। অপসয়মান প্লেনটার দিকে তাকিয়ে আছে সবাই। হোয়াট দ্য হেল ওয়াজ দ্যাট ডিউটিরত অফিসারকে জিজ্ঞেস করলেন কমান্ডার।
অজ্ঞাতপরিচয় একটা প্লেন, ক্যাপটেন।
সামরিক?
না, স্যার। মাথার ওপর দিয়ে যাবার সময় ডানার তলাটা দেখেছি আমি। কোনো মার্কিং নেই।
সম্ভবত একটা স্পাই প্লেন!
মনে হয় না। সব কটা জানালায় আলো ছিল।
অ্যাল জিওর্দিনো মন্তব্য করল, কমার্শিয়াল এয়ার লাইনার?
বিস্মিত কমান্ডার বললেন, লোকটা পাইলট, নাকি গাড়োয়ান? আমার জাহাজকে বিপদে ফেলতে যাচ্ছিল! ব্যাটা এদিকে কী করছে, শুনি? কমার্শিয়াল ফ্লাইটের পথ থেকে কয়েকশো মাইল দূরে রয়েছি আমরা!
প্লেনটা নিচে নামছে, বলল পিট, পুবদিকে তাকিয়ে ক্রমশ ছোটো হয়ে আসা নেভিগেশন লাইটগুলো দেখছে ও। আমর ধারণা, নামতে বাধ্য হচ্ছে ওরা।
এই অন্ধকারে ল্যান্ড করতে যাচ্ছে? জিওর্দিনো ক্রস চিহ্ন আঁকল বুকে। ঈশ্বর ওদের সহায় হোন। কিন্তু তাহলে ল্যান্ডিং লাইট জ্বালেনি কেন?
ডিউটি অফিসার বলল, বিপদে পড়লে পাইলট তো ডিসট্রেস সিগন্যাল পাঠাবে। কমিউনিকেশন রুম কিছুই শোনেনি।
তুমি সাড়া পাবার চেষ্টা করেছ? জিজ্ঞেস করলেন বায়রন নাইট।
হ্যাঁ, রাডারে ধরা পড়ার সাথে সাথে। কোনো রিপ্লাই পাইনি।
জানালার সামনে সরে গিয়ে বাইরে উঁকি দিলেন কমান্ডার। জানালার কাছে চার সেকেন্ড আঙুল নাচালেন। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে মুখোমুখি হলেন ডিউটি অফিসারের। যেখানে আছি সেখানেই থাকছি আমরা।
কেউ কোনো কথা বলল না দেখে পিটই মুখ খুলল, সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার নিঃসন্দেহে আপনারই, তবে সমর্থন বা প্রশংসা করতে পারছি না।