দৈত্যাকার এক লোক ভেনাটরকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে এল। ক্যাম্পের সবার চেয়ে লম্বা সে, বিশাল কাঁধ, আর শক্তিশালী বাহু, হাতের শেষ প্রান্ত ঝুলে আছে হাঁটুর কাছাকাছি।
গল জাতির লোক লাটিনিয়াস মাসার, ক্রীতদাসদের প্রধান ওভারশিয়ার সে। হাত নেড়ে অভ্যর্থনা জানাল ভেনাটরকে, কথা বলল অস্বাভাবিক তীক্ষ্ণ আর কর্কশ কণ্ঠে, সব দেখলেন?
মাথা ঝাঁকালেন ভেনাটর। হ্যাঁ, তালিকা মেলানো হয়েছে। সুড়ঙ্গমুখ বন্ধ করতে পারো।
ধরে নিন বন্ধ হয়েছে।
ক্যাম্পে কিসের হৈচৈ?
ঘাড় ফিরিয়ে সৈনিকদের দিকে একবার তাকাল মাসার, ঘন ভ্রু জোড়ার ভেতর তার লাল চোখ দপ করে জ্বলে উঠল যেন, একদলা থুথু ফেলে আবার তাকাল ভেনাটরের দিকে। তার কথা থেকে জানা গেল, বোকা সৈনিকরা অস্থির হয়ে পড়েছিল, এখান থেকে পাঁচ লীগ উত্তরের একটা গ্রামে হামলা চালিয়ে এইমাত্র ফিরে এসেছে। এই নির্মম রক্তপাতের কোনো মানে নেই। কম করেও চল্লিশজন অসভ্য মারা গেছে। তাদের মধ্যে পুরুষ ছিল মাত্র দশজন, বাকি সবাই শিশু আর নারী। লাভ কিছুই হয়নি, কারণ সোনা আর অন্যান্য জিনিস, যা সৈনিকরা লুট করে এনেছে তার মূল্য গাধার বিষ্ঠার সমানও নয়। আর এনেছে কুৎসিত দর্শন কিছু মেয়ে লোক।
চেহারা কঠোর হয়ে উঠল ভেনাটরের। আর কেউ বেঁচে গেছে?
শুনলাম দু’জন পুরুষ নাকি জঙ্গলে পালিয়েছে।
তারা তাহলে অন্যান্য গ্রামে আওয়াজ দেবে। সর্বনাশ, সেভেরাস দেখছি মৌমাছির চাকে ঢিল ছুঁড়েছে!
সেভেরাস! ঘৃণায় কুঁচকে উঠল মাসারের ঠোঁটের কোণ। ওই ব্যাটা সেঞ্চুরিয়ন আর তার দল শুধু ঘুমোয় আর আমাদের মদ সাবাড় করে! পাছায় গরম লোহার হ্যাঁকা দিন, তবে যদি ওদের কুঁড়েমি দূর হয়।
ওরা আমাদের রক্ষা করবে, সেজন্যই ভাড়া করা হয়েছে, মনে করিয়ে দিলেন ভেনাটর।
কার হাত থেকে রক্ষা করবে? ব্যঙ্গের সুরে জিজ্ঞেস করল মাসার। ধর্মহীন বর্বরদের হাত থেকে, যারা পোকা আর সাপ-ব্যাঙ খায়?
ক্রীতদাসদের এক জায়গায় জড়ো করো, তাড়াতাড়ি বন্ধ করে দাও সুড়ঙ্গমুখ। খুব সাবধান, মাসার, কাজে যেন কোনো খুঁত না থাকে। আমরা চলে যাবার পর অসভ্যরা যেন আবার খুঁড়তে না পারে।
সে ভয় করবেন না। যতটুকু দেখলাম, এই অভিশপ্ত দেশে এমন কেউ নেই যে ধাতুবিদ্যা জানে। মুখ তুলে সুড়ঙ্গপথের মাথার ওপর তাকাল মাসার, গাছের বিশাল কাণ্ড পাশাপাশি সাজিয়ে প্রকাণ্ড মাচা তৈরি করা হয়েছে, মাচার ওপর পাথর, বালি আর মাটির আকাশছোঁয়া স্তূপ। স্তূপটা হেলান দিয়ে রয়েছে পাহাড়ের গায়ে। মাচাটা সরিয়ে নেয়ার পর গোটা পাহাড় ধসে পড়বে, তখন যদি পাঁচশো হাতি থাকে নিচে, একটাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। আপনার মহামূল্য শিল্পকর্ম চিরকাল অক্ষতই থাকবে, ভেনাটর।
নতুন করে আশ্বস্ত বোধ করলেন ভেনাটর। ওভারশিয়ারকে বিদায় করে দিয়ে রাগের সাথে ঘুরে দাঁড়ালেন, সেভেরাসের তাবুর দিকে যাচ্ছেন।
সামরিক বাহিনীর একটা প্রতীক চিহ্নকে পাশ কাটালেন ভেনাটর, বর্শার মাথায় একটা রুপালি ষড়। একজন প্রহরী বাধা দিতে এগিয়ে এল, এক ধাক্কায় তাকে সরিয়ে দিয়ে তাঁবুর ভেতর ঢুকলেন তিনি।
তাঁবুর ভেতর একটা ক্যাম্প-চেয়ারে বসে রয়েছে সেঞ্চুরিয়ান, কোলের ওপর নগ্ন অসভ্য নারী। জীবনে বোধ হয় কখনও গোসল করেনি মেয়েটা। সেভেরাসের দিকে মুখ তুলে দুর্বোধ্য কিচিরমিচির শব্দ করছে সে। বয়স নেহাতই কম, পনেরোর বেশি হবে না। সেভেরাসের গায়ে শুধু বুক ঢাকা আঁটো জামা। তার নগ্ন বাহু একজোড়া ব্রোঞ্জের তৈরি বন্ধনী দিয়ে অলংকৃত, দুই বাইসেপ কামড়ে আছে। একজন বীর যোদ্ধার পেশিবহুল বাহু, ঢাল আর তলোয়ার ধরায় যার রয়েছে দীর্ঘকালের অভিজ্ঞতা।
ভেনাটরের আকস্মিক আগমনে মুখ ফিরিয়ে তাকাবারও প্রয়োজন বোধ করল না সেভেরাস।
তাহলে এভাবেই তোমার সময় কাটছে, সেভেরাস? তিরস্কার করলেন ভেনাটর, তার কণ্ঠে শীতল ব্যঙ্গ। বিধর্মী একটা মেয়েকে নষ্ট করে ঈশ্বরের ক্রোধ অর্জন করছো?
কঠিন কালো চোখ ধীরে ধীরে ঘুরিয়ে ভেনাটরের দিকে তাকাল সেভেরাস। দিনটা আজ এত গরম যে আপনার খ্রিস্টীয় প্রলাপ শোনার ধৈর্য হবে না। আমার ঈশ্বর আপনার ঈশ্বরের চেয়ে অনেক বেশি সহনশীল।
সত্যি, কিন্তু তুমি মূর্তি পূজা করো।
যাকে যার খুশি পূজা করতে পারে, প্রশ্নটা একান্তই বাছাইয়ের। আপনি বা আমি, কেউই আমরা নিজেদের ঈশ্বরকে মুখোমুখি কখনও দেখিনি। কে বলবে কারটা খাঁটি?
যিশু হলেন প্রকৃত ঈশ্বরের সন্তান।
হাল ছেড়ে দেয়ার ভঙ্গিতে মাথা দোলাল সেভেরাস। আপনি আমার ব্যক্তিগত সময় দখল করেছেন। সমস্যা কী, বলে বিদায় হোন।
তুমি যাতে বেচারি মেয়েটাকে নষ্ট করতে পারো?
জবাব না দিয়ে চেয়ার ছেড়ে দাঁড়াল সেভেরাস। বুকে লেপ্টে থাকা মেয়েটাকে বস্তার মতো বিছানার ওপর ছুঁড়ে দিল সে। আমার সাথে যোগ দেয়ার ইচ্ছে আছে আপনার, ভেনাটর? থাকলে বলুন, আপনাকে প্রথম সুযোগ দেব।
সেঞ্চুরিয়নের দিকে তাকিয়ে থাকলেন ভেনাটর। ভয়ের একটা ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেল তাঁর শরীরে। যে রোমান সেঞ্চুরিয়ন একটা পদাতিক বাহিনীকে নেতৃত্ব দেয় তাকে অবশ্যই কঠোর হতে হবে, কিন্তু এ-লোক নির্দয় পশু। এখানে আমাদের কাজ শেষ হয়েছে, বললেন ভেনাটর। ক্রীতদাসদের নিয়ে সুড়ঙ্গমুখ বন্ধ করে দিচ্ছে মাসার। তাঁবু গুটিয়ে জাহাজে উঠতে পারি আমরা।