মনিটরের দিকে ফিরল জিওর্দিনো, এক সেকেন্ড পরই চেঁচিয়ে উঠল সে, ওটা আবার কী! মোটাসোটা একটা জগের মনে হচ্ছে না?
আরে তাই তো! বিস্ময় প্রকাশ করলেন কমান্ডার নাইট। কী হতে পারে?
দীর্ঘক্ষণ মনিটরের দিকে তাকিয়ে থাকল পিট, চিন্তিত। হঠাৎ করে কুঁচকে উঠল জোড়া। জিনিসটা খাড়া হয়ে রয়েছে। সরু গলার দুইপাশে বেরিয়ে রয়েছে দুটো হাতল, ক্রমশ চওড়া হয়ে গোল আকৃতি পেয়েছে। মুখ খুলল ও, ওটা একটা টেরাকোটা জার। রোমান আর গ্রিকরা ওগুলোয় তেল রাখত।
আমার ধারণা তুমি ঠিকই বলেছ, মন্তব্য করলেন বায়রন নাইট। মদ বা তেল নেয়ার জন্য গ্রিক আর রোমানরা ব্যবহার করত ওগুলো। ভূমধ্যসাগরের বহু জায়গায় এ ধরনের অনেক জার পাওয়া গেছে।
ওটা এখানে, গ্রিনল্যান্ড সাগরে কি করছে? জিজ্ঞেস করল জিওর্দিনো। ওই যে, আরেকটা উঁকি দিচ্ছে, ছবির বাঁ দিকে।
তারপর একসাথে আরও তিনটে জার বেরিয়ে গেল ক্যামেরার তলা দিয়ে। এরপর আরো পাঁচটি।
পিটের দিকে ফিরলেন বায়রন নাইট। তুমি তো বেশ কয়েকটা পুরনো জাহাজ উদ্ধার করেছ, এ ব্যাপারটা কীভাবে ব্যাখ্যা করবে?
উত্তর দেয়ার আগে ঝাড়া দশ সেকেন্ড চুপ করে থাকল পিট। যখন কথা বলল, মনে হলো দূর থেকে ভেসে আসছে ওর গলা।
আমার ধারণা, প্রাচীন কোনো বিধ্বস্ত জাহাজ থেকে এসেছে ওগুলো। কিন্তু ইতিহাস বলছে, জাহাজটার এই এলাকায় আসার কোনো কারণ নেই।
.
০৬.
অসম্ভব কাজটা থেকে মুক্তি পাবার জন্য নিজের আত্মা বিক্রি করতেও রাজি আছে রুবিন। ঘামে ভেজা হাত স্টিয়ারিং হুইল থেকে তুলে নিতে চায় সে, ক্লান্ত চোখ বন্ধ করে মেনে নিতে চায় মৃত্যুকে, কিন্তু আরোহীদের প্রতি দায়িত্ববোধ তাকে হাল ছাড়তে দিল না।
নেভিগেশন ইনস্ট্রমেন্টের কোনোটাই কাজ করছে না। প্রতিটি কমিউনিকেশন ইকুইপমেন্ট অচল। আরোহীদের কেউ জীবনে কখনও প্লেন চালায়নি। ফুয়েল গজের কাটা শূন্যের ঘরের কাছে কাঁপছে। দুঃস্বপ্নও বোধ হয় এমন ভয়ংকর হয় না। সামান্য ভুলের ফলে পঞ্চাশজন লোকের সলিল সমাধি ঘটবে অজানা এক সমুদ্রের তলদেশে। ঠিক হলো, নিজের মনেই বলল রুবিন, মোটেও ঠিক হলো না ব্যাপারটা।
অনেক প্রশ্ন মাথা কুটছে রুবিনের মনে। পাইলট কোথায় গেলেন? ফ্লাইট অফিসারদের মৃত্যুর কারণ কী? এই সর্বনাশের পেছনে কার হাত আছে?
একটাই সান্ত্বনা রুবিনের। সে একা নয়। ককপিটে আরেক লোক তাকে সাহায্য করছে। এডুরাডো ইয়াবারা, মেক্সিকো প্রতিনিধিদলের একজন সদস্য, একসময় তার দেশের এয়ারফোর্সে মেকানিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছে। মান্ধাতা আমলের একটা প্লেনে কাজ করার পর পেরিয়ে গেছে ত্রিশটা বছর, তবে কো-পাইলটের সিটে বসার পর ভুলে যাওয়া কারিগরি জ্ঞান একটু একটু করে মনে পড়ল তার। ইনস্ট্রমেন্টের রিডিং জানাচ্ছে সে কে, থ্রটলের দায়িত্ব নিয়েছে।
স্যুট পরিহিত এডুরাডো ছোট্টখাটো মানুষ, গায়ের রং তামাটে, মুখটা প্রায় গোল। ককপিটে তাকে একেবারেই বেমানান লাগছে। আশ্চর্য, একটুও ঘাবড়ায়নি সে, কপালে ঘাম ফোটেনি। কোট তো খোলেইনি, এমনকি টাইয়ের নটটা পর্যন্ত ঢিল করেনি। একটা হাত তুলে উইন্ডশিন্ডের বাইরে, আকাশ দেখল সে। তারা দেখে যতটুকু বুঝতে পারছি, উত্তর মেরুর দিকে যাচ্ছি আমরা।
সম্ভবত পূর্বদিকে রাশিয়ার ওপর দিয়ে, থমথমে গলায় বলল। কোর্স বা দিক, কিছুই জানা নেই।
কিন্তু পেছনে ওটা আমরা একটা দ্বীপ ফেলে এসেছি।
গ্রিনল্যান্ড হতে পারে?
মাথা নাড়ল এডুরাডো ইয়াবারা। গত কয়েক ঘণ্টা আমাদের নিচে পানি রয়েছে। দ্বীপটা গ্রিনল্যান্ড হলে এতক্ষণে আমরা আইসক্যাপের ওপর পৌঁছে যেতাম। আমার ধারণা, আইসল্যান্ডকে পেরিয়ে এসেছি।
মাই গড, তাহলে কতক্ষণ ধরে আমরা উত্তর দিকে যাচ্ছি?
লন্ডন-নিউ ইয়র্ক কোর্স থেকে ঠিক কখন সরে আসেন পাইলট কে জানে।
তাৎক্ষণিক মৃত্যু থেকে আরোহীদের প্রায় অলৌকিকভাবে বাঁচানো সম্ভব হয়েছে। কিন্তু বিপদ কাটেনি। সামনে উত্তর মেরু-হিমশীতল মৃত্যুফাঁদ। বেপরোয়া মানুষ দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারে, ও তাই নিল। পোর্টের দিকে নব্বই ডিগ্রি বাঁক নেব আমি।
শান্তভাবে সায় দিল ইয়াবারা। আর কোনো উপায় দেখছি না।
প্লেন যদি বরফের ওপর আছড়ে পড়ে, দুএকজন বাঁচলেও বাঁচতে পারে। কিন্তু পানিতে পড়ে ডুবে গেলে কারও কোনো আশা নেই। আর যদি মিরাকল ঘটে, অক্ষত অবস্থায় নামাতে পারি প্লেনটাকে, আরোহীরা যে ধরনের কাপড় পরে আছে, কয়েক মিনিটের বেশি বাঁচবে না কেউ।
বোধ হয় অনেক দেরি করে ফেলেছি, মেক্সিকো প্রতিনিধিদলের সদস্য বলল। ইনস্ট্রুমেন্ট প্যানেলের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছে সে। লাল ফুয়েল ওয়ার্কিং লাইট ঘন ঘন জ্বলছে আর নিভছে। আকাশে ভেসে থাকার সময় শেষ হয়েছে আমাদের।
লাল আলোটার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকল। তার জানা নেই, দেড় হাজার মিটার ওপরে দুশো নট গতিবেগে বোয়িং প্লেন যে পরিমাণ ফুয়েল হজম করে, সাড়ে দশ হাজার মিটার ওপরে পাঁচশো নট গতিবেগেও সেই একই পরিমাণ ফুয়েল হজম করে। সে ভাবল, যা আছে কপালে। পশ্চিম দিকে যেতে থাকি, তারপর যেখানে খুশি পড়ক গে। ঈশ্বর ভরসা।
হাতের তালু ট্রাউজারের পায়ায় মুছে নিয়ে শক্ত করে কন্ট্রোল কলাম ধরল সে। গ্লেসিয়ারের চূড়া টপকাবার পর এই প্রথম আবার প্লেনের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নিল। বড় করে একটা শ্বাস টেনে চাপ দিল অটোপাইলট রিলিজ বোতামে। ধীর ভঙ্গিতে ঘোরাতে শুরু করল প্লেন।