নিচে নেমে ওঁরা দেখলেন, সাধারণ তারের বেড়া দিয়ে ঘেরা হয়েছে জায়গাটা। গেটে একটা সাইনবোর্ড ঝুলছে। তাতে লেখা স্যাম ট্রিনিটি স্যান্ড অ্যান্ড গ্র্যাভেল কোম্পানি। বড় আকারের কিছু বালতি, একটা ট্রাক, গোটা দশের কোদাল আর বেলচা ছাড়া গোটা এলাকা খালি পড়ে আছে।
সিকিউরিটি গার্ড ইউনিট, ইলেকট্রনিক ডিটেকশন ইকুইপমেন্ট ইত্যাদি সবই আছে, তবে চোখের আড়ালে।
মি. স্যাম ট্রিনিটির সাথে আমার দেখা হতে পারে? জিজ্ঞেস করলেন প্রেসিডেন্ট। মাথা নাড়লেন অ্যাডমিরাল। খুব ভালো মানুষ। স্বেচ্ছায় সরকারকে তার সম্পত্তি লিখে দেয়ার পর গলফ খেলার জন্য ওয়ার্ল্ড ট্যুর করতে বেরিয়েছে সে।
আশা করি তাকে ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়েছে, তাই না?
ট্যাক্সমুক্ত দশ মিলিয়ন ডলার, বললেন অ্যাডমিরাল। নিতে রাজি করার জন্য রীতিমতো হাতে-পায়ে ধরতে হয়েছে। কয়েকশো মিটার দূরে গভীর একটা গর্ত দেখালেন অ্যাডমিরাল, গনগোরা হিলের ওই হলো অবশিষ্ট। এখন ওটা নুড়ি পাথর আর কাকরের খনি। ওগুলো বিক্রি করেও লাভের মুখ দেখব আমরা।
প্রেসিডেন্ট জিজ্ঞেস না করে পারলেন না, টপিটজিন আর ইয়াজিদের লাশ দুটো কি আপনারা খুঁজে পেয়েছেন?
মাথা ঝাঁকালেন অ্যাডমিরাল। দুদিন আগে। যতটুকু পাওয়া গেছে আর কী। সব রক ক্রাশারে ঢেলে দেয়া হয়েছে। আমার বিশ্বাস দু’জনেই তারা রাস্তার উপকরণ হয়ে আছে।
প্রেসিডেন্টকে সন্তুষ্ট দেখাল, যার যা প্রাপ্য।
টানেলটা কোথায়? চারদিকে তাকালেন মার্টিন ব্রোগান।
এই যে, এদিকে। ইঙ্গিতে একটি মোবাইল ট্রেইলর দেখালেন অ্যাডমিরাল, ওটাকে একটা অফিসে রূপান্তর করা হয়েছে। জানালায় বড় বড় অক্ষরে লেখা ডিসপ্যাচার।
মোবাইল অফিসে উঠে এলেন ওঁরা, আরেক দরজা দিয়ে নেমে পড়লেন সবাই সমতল টানেলের মেঝেতে। শুরু হলো আধুনিক ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতির প্রদর্শনী। একাদিক টিভি ক্যামেরা রয়েছে সিলিং আর দেয়ালে। দরজায় মেটাল ডিটেকটর মেশিন। জেনারেটরের আওয়াজ শোনা গেল। সিলিংয়ের সার সার টিউব লাইট জ্বলছে। খানিক দূর এগিয়ে এলিভেটরে চড়লেন ওঁরা।
সারফেস থেকে ত্রিশ মিটার নেমে এল এলিভেটর। টানেলে বেরিয়ে এসে সার সার দাঁড় করানো ভাস্কর্য দেখতে পেলেন ওঁরা, দেয়াল ঘেঁষে রাখা হয়েছে।
একজন তরুণী এগিয়ে এসে অভ্যর্থনা জানাল ওদের।
মি. প্রেসিডেন্ট, অ্যাডমিরাল বললেন, আপনার সাথে পরিচয় করিয়ে দিই। ইনি ড. শার্প, ক্যাটালগিং প্রোগ্রামের ডিরেক্টর।
ড, শার্প, আমরা আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ।
লালচে চেহারা নিয়ে লিলি বলল, আমার অবদান খুবই সামান্য…
সবার সাথে করমর্দনের পর অতিথিদের নিয়ে রওনা হলো লিলি। আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরি দেখানোর জন্য তাকেই গাইড নির্বাচিত করা হয়েছে।
চারশো পঁচিশ ধরনের স্কাল্পচার ক্যাটালগে তুলেছি আমরা, ব্যাখ্যা করল সে। তার মধ্যে খ্রিস্টা-পূর্ব তিন হাজার সালের ব্রোঞ্জমূর্তিও আছে। শেষ দিকের, অর্থাৎ চতুর্থ শতাব্দীর মূর্তিও অনেক। সামান্য দাগ ছাড়া ওগুলোর কোনো ক্ষতি হয়নি, দাগগুলোও কেমিক্যালের সাহায্যে তোলা যাবে।
দীর্ঘ প্যাসেজ ধরে নিঃশব্দে হাঁটছেন প্রেসিডেন্ট। মূর্তিগুলোর দিকে তাকিয়ে বিস্ময় বাধ মানছে না তার। কোনো কোনোটা পাঁচ হাজার বছরের পুরনো। মূর্তির সংখ্যা দেখেও অবাক হলেন। প্রতিটি যুগের, প্রতিটি সাম্রাজ্যের শিল্পকর্ম স্থান পেয়েছে আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরিতে যা চোখে দেখতে পাব।
বিস্ফোরণে কোনো ক্ষতিই হয়নি লাইব্রেরির, বলল লিলি। টানেলের ভেতর সামান্য মাটি খসে পড়েছিল শুধু।
একটানা দুঘন্টা দরে প্রদর্শনী দেখার পর সর্বশেষ শিল্পকর্মটির পাশে এসে দাঁড়ালেন ওঁরা। সবাইকে নিয়ে এবার প্রধান গ্যালারিতে ঢুকবে লিলি। হাত বাড়াল সে, ফিসফিস করে বলল, ওই যে, আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট-এর স্বর্ণের কফিন।
প্রেসিডেন্টর অনুভূতি হলো, তার সাথে যেন ঈশ্বরের দেখা হতে যাচ্ছে। দুনিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ নেতাদের একজন, মহাবীর আলেকজান্ডার। কাঁপা পায়ে এগোলেন প্রেসিডেন্ট।
কফিনটা খোলা রয়েছে। আলেকজান্ডারের বর্ম ও হেলমেট খাঁটি সোনার তৈরি। পারস্যের সিল্ক দিয়ে তৈরি হয়েছিল তার টিউনিক, বেশির ভাগই অদৃশ্য হয়েছে, প্রায় চব্বিশ শতাব্দীর পর অবশিষ্ট আছে সামান্য কিছু গঁড়ো। মহাবীর আলেকজান্ডারের অবশিষ্ট বলতেও রয়েছে শুধু কখানা হাড়।
ক্লিওপেট্রা, জুলিয়াস সিজার, মার্ক অ্যান্টনি, সবাই শ্রদ্ধাবনত মস্তকে দাঁড়িয়েছেন। এই মহানায়কের কফিনের পাশে, লেকচার দিল লিলি।
প্রায় ত্রিশজন লোক কঠোর পরিশ্রম করছে। গ্যালারির মাঝখানে জড় করা কাঠের বাক্সের ভেতর কী আছে দেখার কাজে একদল লোক ব্যস্ত। একদিকের দেয়ালে সার সার সাজানো রয়েছে পেইন্টিং। হাতির দাঁত, মার্বেল, সোনা, রুপা ও তামা দিয়ে অদ্ভুত সব খেলনা, মূর্তি, ব্যবহারিক উপকরণ ইত্যাদি বানানো হয়েছে। শ্রেণীবিভাগের কাজ চলছে, কাজ চলছে নতুন বাক্সে ভরার। পার্চমেন্ট ও প্যাপিরাসগুলো পাঠিয়ে দেয়া হবে মেরিল্যান্ডে, বিশ্লেষণ ও সংরক্ষণের জন্য।
হাত নেড়ে গ্যালারির চারদিকটা দেখাল লিলি। এই হলো প্রাচীন দুনিয়ার জ্ঞান আর শিল্প, আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরি। এরই মধ্যে হোমারের সমস্ত রচনা উদ্ধার করেছি আমরা। যেসব গ্রিক দার্শনিকদের দর্শন হারিয়ে গিয়েছিল, বেশির ভাগই রয়েছে। এখানে। আদি হিব্রু সাহিত্য পাবার পর খ্রিস্টধর্মের ওপর নতুন আলোকপাত সম্ভব হবে। কিছু ম্যাপ থেকে অজানা মন্দির, প্রাচীন রাজা ও রানীদের সমাধি, নাম-না-জানা বাণিজ্যিক শহর, সোনা আর হীরের খনি, তেলখনি ইত্যাদির ঠিকানা জানা যাচ্ছে। ইতিহাসের মাঝখানে যেসব সভ্যতার কথা আমরা কখনও শুনিওনি, সহজবোধ্য রূপকথার গল্পের মতো সমস্ত কিছু পড়ে ফেলছেন আমাদের বিশেষজ্ঞরা।