জিওর্দিনোর মতে, ও হলো অতীতকে খুঁড়ে আনা ব্যক্তি। মাঝেমধ্যেই ঠাট্টা করে কথাটা বলে সে।
তুমি বোধ হয় এটা দেখতে চাইবে, কামরার আরেক প্রান্ত থেকে বলল অ্যাল জিওর্দিনো।
কালার ভিডিও মনিটরের ওপর আরও কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকল পিট। সার্ভে শিপ আইসব্রেকার পোলার এক্সপ্লোরার-এ রয়েছে ওরা। খোলের একশো মিটার নিচের দৃশ্য দেখতে পাচ্ছে ও। পোলার এক্সপ্লোরার ভোতা চেহারার বিশাল জাহাজ, বিশেষভাবে তৈরি করা হয়েছে বরফবহুল পানিতে চলার জন্য। বাক্স আকৃতির প্রকাণ্ড সুপারস্ট্রাকচার পাঁচতলা অফিস ভবনের মতো দেখতে। জাহাজটাকে চালায় আশি হাজার ঘোড়ার ইঞ্জিন। দেড় মিটার পুরু বরফ ভেঙে অনায়াসে এগোতে পারে।
মনে হচ্ছে যেন একটা গর্ত এগিয়ে আসছে। সামনে একটা কনসোল নিয়ে বসে রয়েছে অ্যাল জিওর্দিনো, সোনার রেকর্ডার স্টাডি করছে। সব কিছু মিলিয়ে তার চেহারাটা বুলডোজারের কাছাকাছি। আদি নিবাস ইটালিতে। একটা কানে ইয়াররিং লটকানো। শুধু বন্ধু নয়, অনেকক্ষেত্রেই পিটের বীমা পলিসি হিসেবে কাজ করে সে।
একটা কাউন্টারে পা ঠেকাল পিট, ভাঁজ করা হাঁটু সমান করল সজোরে, সুইভেল চেয়ারটা ঘুরল, সেই সাথে চাকাগুলো গড়াতে শুরু করে অ্যাল জিওর্দিনোর পাশে পৌঁছে দিল ওকে। কম্পিউটারের সাহায্য পাওয়া সোনোগ্রাফ-এর দিকে তাকিয়ে থাকল ও, উঁচু কিনারা নিয়ে সত্যি একাটা গর্ত ধীরে ধীরে পরিষ্কার হচ্ছে। একসময় অন্ধকার গভীর গর্তের ভেতরটারও আভাস পাওয়া গেল। পাশ থেকে অ্যাল জিওর্দিনো মন্তব্য করল, ঝপ করে নেমে গেছে খাদটা।
চট করে একবার ইকো সাউন্ডারের ওপর চোখ বুলালো পিট। একশো চল্লিশ থেকে একবারেই একশো আশি মিটার।
অথচ কিনারা থেকে বাইরের কোনো দিকে ঢাল নেই।
দুশো মিটার, এখনও তল দেখা যাচ্ছে না।
যদি আগ্নেয়গিরি হয়, স্বীকার করতে হবে আকৃতিটা অদ্ভুত। লাভা পাথরের কোনো চিহ্ন নেই।
বায়রন নাইট, সার্ভে ভেসেলের কমান্ডার, দরজা খুলে ভেতরে উঁকি দিলেন। লালমুখো একটা গরিলাই বলা যায় তাকে। পি আর অ্যাল জিওর্দিনো বাদে গোটা জাহাজে তিনিই শুধু ইলেকট্রনিক্স কমপার্টমেন্টে ঢুকতে পারেন। রাত জাগা পাখিদের কিছু দরকার থাকলে বলতে পারে। হাসছেন তিনি।
কফি। ধন্যবাদ, কমান্ডার, বলল পিট, মাথাটা টেনে নিয়ে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দিলেন বায়রন নাইট।
সোনোগ্রাফে চোখ রেখে আকৃতিটাকে বড় হতে দেখল জিওর্দিনো। ডায়ামিটারে প্রায় দুকিলোমিটার। …
তলাটা সমতল, বলল পিট।
নিশ্চয়ই প্রকাণ্ড একটা আগ্নেয়গিরি ছিল একসময়…
উহু, তা নয়।
পিটের দিকে অদ্ভুতদৃষ্টিতে তাকাল জিওর্দিনো। তাহলে?
উল্কার আঘাত হতে পারে না?
চেহারায় সন্দেহ নিয়ে চিন্তা করল জিওর্দিনো। সাগরের এত গভীরে উল্কার আঘাতে এই প্রকাণ্ড গর্ত তৈরি হতে পারে?
হয়তো কয়েক হাজার বা কয়েক মিলিয়ন বছর আগে পড়েছিল, যখন মি লেভেল অনেক নিচু ছিল।
তোমার এ রকম ভাবার কারণ?
কারণ তিনটে, বলল পিট। গর্তের মুখটা বড় বেশি নিখুঁত, উঁচু-নিচু নয়। বাইরের দিকে কোনো ঢাল নেই। আর, ম্যাগনেটোমিটারের দিকে তাকিয়ে দেখো কাঁটাটা কেমন লাফাচ্ছে, তার মানে নিচে যথেষ্ট লোহা রয়েছে।
হঠাৎ আড়ষ্ট হয়ে গেল জিওর্দিনো। আমরা একটা টার্গেট পেয়েছি!
কোন দিকে?
স্টারবোর্ড সাইডে, দুশো মিটার দূরে। গর্তের ভেতর দিকের ঢালে খাড়াভাবে রয়েছে। রিডিং খুবই আবছা। জিনিসটাকে আংশিক আড়াল করে রেখেছে জিওলজি। কমান্ডারকে খবরটা দাও। ভিডিও ক্যামেরা কি বলে?
মনিটরগুলোর দিকে তাকাল পিট। রেঞ্জের মধ্যে পাচ্ছে না। পরের বার পাশ কাটানোর সময় পাবে।
দ্বিতীয়বার পাশ কাটালে রাশিয়ানরা সন্দেহ করবে না?
রেকডিং পেপারে সোনার ইমেজ এল আবছা। নানা ধরনের পদার্থের আড়াল করা একটা দাগ মাত্র। তারপর এল কম্পিউটর ইমেজ, অনেকটা পরিষ্কার ও বিশদ বিবরণসহ। ইমেজটা ফোঁটানো হলো কালার ভিডিও মনিটরে। এতক্ষণে একটা প্রায় স্পষ্ট আকৃতি পাওয়া গেল। বোম টিপে আকৃতিটাকে আরও বড় করল পিট স্ক্রিন।
টার্গেটের চারদিকে আপনাআপনি একটা চতুষ্কোণ তৈরি হলো, ফলে আরও পরিষ্কারভাবে ধরা পড়ল জিনিসটার ধাচ আর আকৃতি। একই সময়ে আরেকটা মেশিন থেকে বেরিয়ে এল রঙিন আকৃতি।
হন্তদন্ত হয়ে ভেতরে ঢুকলেন কমান্ডার নাইট। দিনের পর দিন গোটা এলাকা চষে ফেলেছে পোলার এক্সপ্লারার, নিখোঁজ রাশিয়ান সাবমেরিনের কোনো সন্ধান না পাওয়া হতাশ হয়ে পড়েছিলেন ভদ্রলোক, পিটের আকস্মিক ডাক পেয়ে উত্তেজিত হয়ে উঠেছেন। পেয়েছো? টার্গেট পেয়েছো? রুদ্বশ্বাসে জানতে চাইলেন
পিট বা জিওর্দিনো, দু’জনের কেউই জবাব দিল না, নিঃশব্দে হাসতে লাগল। হঠাৎ বুঝতে পারলেন কমান্ডার নাইট।
গুড গড! সত্যি আমরা পেয়েছি ওটাকে? …।
বিশাল এক গর্তের ভেতর লুকিয়ে আছে, কমান্ডারের হাতে একটা ফটো ধরিয়ে দিয়ে মনিটরের দিকে ইঙ্গিত করল পিট। আলফাক্লাস সোভিয়েত সাবমেরিনের নিখুঁত একটা ইমেজ।
ফটো আর সোনার ইমেজের ওপর চোখ বুলিয়ে মুখ তুললেন বায়রন নাইট। সাগরের এদিকটা কোথাও খুঁজতে বাকি রাখেনি রাশিয়ানরা। পায়নি। কেন?
না পাওয়ার কারণ আছে, বলল পিট। ওরা যখন খোঁজ করে তখন বরফের স্তর অনেক মোটা ছিল। পাশাপাশি সরল রেখা তৈরি করে আসা-যাওয়া করতে পারেনি ওদের জাহাজগুলো। ওদের সোনার বীম শুধু ছায়া দেখাতে পেরেছে। তাছাড়া গর্তের তলায় প্রচুর লোহা থাকায়…