টেবিলের দিকে তাকিয়ে সিনেটর পিট বললেন, প্ল্যানটা কী, অল্প সময়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়, মি. প্রেসিডেন্ট। পুরো ব্যাপারটা আমার ছেলে, ডার্ক পরিকল্পনা করেছে। সব যদি ঠিকঠাক মতো ঘটে তাহলে টপিটজিন অর্থাৎ রবার্ট ক্যাপেসটার আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরিতে হাত লাগাতে পারবে না, এইটুকু প্রতিশ্রুতি আপনাদের আমি দিতে পারি। তবে, প্ল্যানটা যদি ব্যর্থ হয়, ক্যাপেসটার পরিবার চিরকাল শাসন করবে মেক্সিকোকে এবং চিরকালের জন্য হারিয়ে যাবে আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরি।
৭৫. ধর্মীয় উন্মাদনা
৭৫.
সবাই এই ভেবে কৃতজ্ঞ বোধ করল যে লাখো মানুষের ধর্মীয় উন্মাদনা এবং টপিটজিনের ক্ষমতা দখলের লোভ এখনও কোনো রক্তপাত ঘটায়নি। বুলেটের আঘাতে মারা যায়নি কেউ। শুধু প্রথমবার নদী পেরোতে গিয়ে কিছু লোক ডুবে মারা গেছে।
মিছিলের পর মিছিল আর্মি ইউনিটগুলোকে পাশ কাটিয়ে এল, রোমা শহরের ভেতর দিয়ে ধীরগতিতে গনগোরা হিলের দিকে এগোচ্ছে জনস্রোত। গান থেমে গেছে, শুরু হয়েছে আযটেক ভাষার শ্লোগান, বেশির ভাগ মেক্সিকান দর্শক বা আমেরিকানরা তার কিছুই বুঝল না।
পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উঠতে শুরু করল মিছিলগুলো, নেতৃত্ব দিচ্ছে টপিটজিন। সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে আত্মবিশ্বাস বহুগুণ বেড়ে গেছে তার। মিসরীয় গুপ্তধন হাতের নাগালে চলে আসছে। লাইব্রেরির দলিল, নকশা, শিল্পকর্ম ইত্যাদি সবই নগদ টাকায় রূপান্তর করা হবে। হাতে অঢেল টাকা থাকলে তার রাজনৈতিক সংগঠনের ভিত সারা দেশে শক্তিশালী করা কোনো সমস্যা নয়। ইলেকশনের জন্য অপেক্ষা করার দরকার কী, পেশাদার ও সুসংগঠিত কর্মিবাহিনীকে দিয়ে, পেশিশক্তির সহায়তায়, দো লরেঞ্জো সরকারকে উৎখাত করলেই তার স্বপ্ন সার্থক হবে। আর, একবার যদি ক্ষমতা পায় সে, মেক্সিকোকে ক্যাপেসটার পরিবারের সাম্রাজ্য ঘোষণা করা সময়ের ব্যাপার মাত্র।
মিসরে তার ভাইয়ের মৃত্যু সংবাদ এখনও তার কানে আসেনি। তুমুল উত্তেজনার মুহূর্তে তার উপদেষ্টা আর ঘনিষ্ঠ সহকারীরা কমিউনিকেশন ট্রাক ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিল, ফলে জরুরি বার্তাটা শুনতে পায়নি। হাতে ধরা প্ল্যাটফর্মের পিছু পিছু আসছে তারা, গুপ্তধন দেখার লোভ সামলাতে পারেনি।
সাদা আলখেল্লা পরেছে টপিটজিন, মাথা আর কাঁধ থেকে ঝুলে আছে একটা বাঘের ছাল। তার হাতে, কাপড় পেঁচানো সরু বাঁশের মাথায় এটা ব্যানার, তাতে সাপ ও ঈগলের ছবি আঁকা। এক গাদা পোর্টেবল স্পটলাইটের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে আছে। প্ল্যাটফর্মটা। হাত-ইশারায় সামনের ঢালে আলো ফেলার নির্দেশ দিল সে।
ভারী কিছু ইকুইপমেন্ট ছাড়া দেখার মতো কিছু নেই। খোঁড়াখুড়ির কাজ ফেলে চলে গেছে সবাই। গভীর গর্তটায় বা টানেলে কাউকেই দেখা গেল না। পরিবেশটা পছন্দ হলো না টপিটজিনের। একটা হাত তুলে মিছিলগুলোকে থামার নির্দেশ দিল সে।
আচমকা পাহাড়ের চূড়া থেকে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল নারীকণ্ঠের সূতীক্ষ্ণ বিলাপধ্বনি। তীব্র থেকে তীব্রতর হলো আধিভৌতিক আওয়াজটা, যেন কোনো বিদেহী আত্মা বা বাস্তপরী আর্তনাদ করে। চিৎকারটা এতই জোরাল, এতই কর্ণবিদারক যে মিছিলে উপস্থিত নারী ও পুরুষরা কানে হাত চাপা দিতে বাধ্য হলো।
এরপর হঠাৎ করেই অনেকগুলো স্ট্রোবলাইটের অত্যুজ্জ্বল আলো সরাসরি মেক্সিকান জনতার মুখের ওপর ঘুষির মতো আঘাত করল। আরেকটা আলোর টানেল, নিঃসঙ্গ উত্তর আকাশের কালো গায়ে বিচিত্র আকৃতির নকশা বোনায় ব্যস্ত। হতভম্ব, সম্মোহিত জনতা নির্বাক তাকিয়ে থাকল আলোটার দিকে।
প্রতি মুহূর্তে উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হলো আলোর প্রদর্শনী। বাতাসে চাবুক মারার সাথে প্রায় হুবহু মিল রেখে অদৃশ্য নারীকণ্ঠের আর্তনাদ বিরতিহীন অত্যাচার হয়ে দাঁড়াল।
তারপর হঠাৎ করেই নিভে গেল স্ট্রোবলাইট, থেমে গেল বিলাপধ্বনি।
তারপরও ঝাড়া প্রায় এক মিনিট ধরে সেই লোমহর্ষক চিৎকার শুনতে পেল জনতা, চোখে লেগে থাকল আলোর বিস্ফোরণ। তারপর, অজানা, উৎস থেকে তাক করা এক টুকরো আলো ধীরে ধীরে উদ্ভাসিত করে তুলল দীর্ঘদেহী এক ছায়ামূর্তিকে, দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়-চূড়ায়। দৃশ্যটা নিখাদ ভৌতিক। ছায়ামূর্তিকে ঘিরে থাকা ধাতব আবরণে লেগে বিচ্ছুরিত হলো আলো, পাহাড়ের ঢালে দাঁড়িয়ে থাকা জনতার মধ্যে অনেকের চোখ ধাধিযে গেল।
দীর্ঘদেহীর সারা শরীর আলোকিত হয়ে উঠল। এখন তাকে চেনা যাচ্ছে। যোদ্ধার পোশাকে একজন রোমান সৈনিক। তার কোমরে রয়েছে দুফলা তলোয়ার, একহাতে বর্শা, অপর হাতে গোল ঢাল।
হতচকিতভাব নিয়ে তাকিয়ে থাকল টপিটজিন। খেলা, নাকি কৌতুক? আমেরিকানদের ফন্দিটা কী? আলোকিত রোমান সৈনিকের দিক থেকে আটক দেবতার দিকে ফিরল জনতা, প্রত্যাশায় অধীর হয়ে অপেক্ষায় থাকল তিনি কী করেন দেখার জন্য।
মরিয়া হয়ে ধোঁকা দেয়ার চেষ্টা করতে আমেরিকানরা, সিদ্ধান্ত নিল টপিটজিন। মিছিল নিয়ে গুপ্তধনের কাছে তাকে পৌঁছাতে না দেয়ার হাস্যকর অপচেষ্টা।
ব্যাপারটা ফাঁদ হতে পারে, তার উপদেষ্টাদের একজন মন্তব্য করলেন, আপনাকে কিডন্যাপ করে জিম্মি রাখতে চায়।
ঘৃণার সাথে তার দিকে তাকাল টপিটজিন।
চালাকি হতে পারে। বাট কিডন্যাপ, নো আমার গায়ে হাত দিলে জনতা খেপে উঠবে, আমেরিকানরা জানে। ওরা আসলে আমার সাথে আলোচনায় বসতে চাইছে। স্টেট ডিপার্টমেন্টে অফিসারদের সাথে বৈঠক করার অনেক প্রস্তাব আগে আমাকে দিয়েছে ওরা, কান দিইনি আমি। ভৌতিক পরিবেশটা তৈরি করা হয়েছে স্রেফ আমার সাথে মুখোমুখি বসার শেষ একটা চেষ্টা হিসেবে। কী বলার আছে ওদের শুনতে পেলে মন্দ হয় না।