আপনার নির্দেশ নিয়ে তর্ক চলে না, আমি জানি, মি. প্রেসিডেন্ট বললেন। কিন্তু পাঁচ লাখ লোক কাঁধে কাঁধ ঠেকিয়ে এগিয়ে এলে, আমাকে যদি তাদের লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়তে হয়, ইতিহাসে মানবতার বিরুদ্ধে ভয়ঙ্কর অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে সেটা।
এখন মনে হচ্ছে বটে শান্তিপূর্ণ সমাবেশ কিন্তু সীমান্ত পেরিয়ে ভেতরে ঢোকার পর মিছিলগুলো শান্তিপূর্ণ থাকবে না, বললেন প্রেসিডেন্ট। উন্মত্ত জনতা আমেরিকানদের যাকেই সামনে পাবে, নির্মমভাবে খুন করবে। কোনো আমেরিকান মেক্সিকান নাগরিক আজ আর নিরাপদ নয়।
ঝাড়া বিশ সেকেন্ড চুপ করে থাকলেন জেনারেল কার্টিস। কামরার প্রতিটি লোক বুঝতে পারছে, কী দ্বিধা কাজ করছে জেনারেলের মনে।
আমি চাই কমিউনিকেশন লাইন সারাক্ষণ খোলা থাকুক।
থাকবে।
ধন্যবাদ, প্রেসিডেন্ট।
তো, শিলার মন্তব্য করলেন, যতটা সম্ভব চেষ্টা আমরা করেছি। এখন শুধু অপেক্ষা।
.
৭৪.
সন্ধ্যার এক ঘণ্টা পর রওনা হলো ওরা।
জনস্রোতের সামনের অংশে থাকল মহিলা, শিশু, পুরুষ। সবার হাতে জ্বলন্ত মোমবাতি। বৃষ্টি থেমে যাবার পরও আকাশে ইতস্তত করছে মেঘ, অগণিত মোমবাতির শিখা গোলাপি আভা দান করল মেঘের গায়ে।
বিশাল একটা ঢেউ-এর মতো নদীর তীর লক্ষ্য করে এগোল তারা, লাখো জনতার সম্মিলিত কণ্ঠ থেকে ধর্মীয় সঙ্গীতের সুর প্রথমে গুঞ্জনের মতো শোনাল, ক্রমশ বদলে গিয়ে হয়ে উঠল গুরুগম্ভীর গর্জন। পাহাড়ের গায়ে লেগে ফিরে এল প্রতিধ্বনিগুলো, থরথর করে কাঁপতে শুরু করল রোমার জানালা দরজা।
নদীর পাড়ের দিকে পথটা কাদায় থকথক করছে। শুধু আছাড় খেয়ে পড়ে নয়, অনেক শিশু ভয়েও কেঁদে উঠছে, গ্রাম্য মায়েরা বুকে তুলে নিয়ে আদর করছে বাচ্চাদের। বড়দের কারো চেহারায় ভয় বা উদ্বেগের চিহ্নমাত্র নেই। বেশিরভাগ তারা বস্তিবাসী, আধপেটা খেয়ে জীবন ধারণ করছে যুগের পর যুগ। আধুনিক আযটেক দেবতা টপিটজিন তাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, সীমান্ত পেরিয়ে পূর্ব-পুরুষদের হাপিট শহরগুলো দখল করতে পারলে গরিব মানুষের ভাগ্য রাতারাতি বদলে যাবে। দখলদার আমেরিকানদের তাড়িয়ে দেয়া কোনো সমস্যা নয়, এতো লোককে একসাথে সীমান্ত পেরুতে দেখলে ভয়েই তারা লেজ গুটিয়ে পালাবে। সরল, নিরীহ মেক্সিকানরা বিশ্বাস করেছে তার কথা। নদীর পাড় থেকে ধীরে ধীরে, সতর্কতার সাথে পানিতে নামল তারা, পরস্পরকে যথাসম্ভব সাহায্য করল। দেখতে দেখতে হাজার হাজার নৌকো, ইঞ্জিনচালিত বোট আর ভেলা ভর্তি হয়ে গেল। নদীর পাড়ে তারপরও দাঁড়িয়ে থাকতে রাজি নয় অনেকে, কাঁধে বাচ্চাকে নিয়ে পানিতে নামল তারা, সাঁতার কেটে নদী পেরুবে। জনস্রোতের আরেকটা অংশ ব্রিজের দিকে এগোল। কিছু লোকের নদীতে নামার ইচ্ছে ছিল না, কিন্তু পেছন থেকে ভিড়ের প্রচণ্ড চাপ নামতে বাধ্য করল তাদেরকে।
ভয়ার্ত চিৎকার শোনা গেল। আছাড় খেয়ে পড়ার পর সঙ্গীদের পায়ের তলায় চ্যাপ্টা হলো বহু লোক। অনেক নৌকো উল্টে গেল, ডুবে গেল সাঁতার না জানা বহু শিশু ও বৃদ্ধ। তবু, জনস্রোতের অগ্রযাত্রা থামল না। কয়েক মিনিটের মধ্যে বহু শিশু আর বৃদ্ধ। তবু, জনস্রোতের অগ্রযাত্রা থামল না। কয়েক মিনিটের মধ্যে গোটা নদীতে ছড়িয়ে পড়ল ছোটো ছোটো জলযানগুলো।
মার্কিনীদের আর্মি সার্চলাইট আর টেলিভিশন ক্রুদের ফ্লাডলাইট নদীর ওপর বিশৃঙ্খল দৃশ্যটাকে আলোকিত করে রেখেছে। আনাড়ি লোকজনের করুণ পরিণতি এবং সচল মানব-পাঁচিলের অগ্রযাত্রা বিস্ময়-বিস্ফারিত চোখে দেখতে সৈনিকরা।
রাফ-এর মাঝখানে রোমার পুলিশ স্টেশন, তার ছাদে দাঁড়িয়ে রয়েছেন জেনারেল নিউগল কার্টিস। উজ্জ্বল আলোয় ফ্যাকাসে দেখায় তার চেহারা, চোখে উদভ্রান্ত দৃষ্টি। কপালের সাথে ক্লিপ দিয়ে আটকানো খুদে মাইক্রোফোনে কথা বললেন তিনি,
দেখতে পাচ্ছেন, মি. প্রেসিডেন্ট? দেখতে পাচ্ছেন কী রকম পাগলামি?
সাবইকে নিয়ে সিচ্যুয়েশন রুমে রয়েছেন প্রেসিডেন্ট, একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন বিশাল মনিটরের দিকে।
হ্যাঁ, ট্রান্সমিশন পরিষ্কার আসছে। লম্বা একটা টেবিলের মাথায় বসে আছেন তিনি, সাথে রয়েছেন ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও উপদেষ্টারা এবং চারজন জয়েন্ট চিফস অব স্টাফ-এর দু’জন।
তীরে পৌঁছাল প্রথম দ্রুতগামী বোটগুলো। ঝটপট নেমে পড়ল আরোহীরা। হাজার হাজার নৌকা ও বোট তীরে ভেড়ার পর জনস্রোতের প্রথম ঢেউটা ধীরে ধীরে বিশাল এক মিছিলের আকৃতি পেল। আরোহীদের নামিয়ে দিয়েই ফিরতি পথে রওনা হয়ে গেছে জনযানগুলো।
নারী ও শিশুদের সাথে অল্প কিছু পুরুষ এ পারে এসেছে, মিছিলের মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ল তারা, সবার মুখে একটা করে বুলহন, মহিলা নেত্রীদের উৎসাহ ও নির্দেশ দিচ্ছে।
মহিলাদের এক হাতে জ্বলন্ত মোমবাতি, অপর হাত বুকের সাথে চেপে ধরে আছে। দুগ্ধপোষ্য শিশুকে, মুখে প্রাচীন আযটেক গান, ব্লাফটাকে ঘিরে চক্কর দিতে শুরু করল। ব্লাফের নিচের ঢালগুলোতে উঠে পড়ল অনেকে, সার সার বসানো কামান আর সৈনিকদের হাতে ধরা রাইফেলের মাজল তাক করা হয়েছে দেখে ভয় পেয়ে কেঁদে উঠল বাচ্চারা। মায়েদের মনে কোনো ভয় নেই, কারণ আযটেক অবতার টপিটজিন আশ্বাস দিয়েছে, তার আধ্যাত্মিক শক্তিই রক্ষা করবে তাদেরকে।