আপনার সেবা করতে গিয়ে, ধীরে ধীর বলল সুলেমান আজিজ, এই মূল্য দিতে হয়েছে আমাকে।
তুমি বেঁচে আছ কী করে? জিজ্ঞেস করল আখমত ইয়াজিদ, তার গলা কেঁপে গেল।
আমার বিশ্বস্ত ভক্ত ইবনে দ্বীপটায় দুদিন লুকিয়ে রাখে আমাকে। নিজের হাতে কাঠের একটা ভেলা তৈরি করে সে। স্রোত আমাদের টেনে নিয়ে যায় একটানা দশ ঘণ্টা। আল্লাহ মেহেরবান, চিলির একট ফিশিং বোট আমাদের তুলে নিয়ে নামিয়ে দেয় তীরে, সেখান থেকে প্লেনে করে চলে আসি ডেল পান্টায়। ওখান থেকে প্লেন চার্টার করে মিসরে পৌঁছুতে তেমন অসুবিধা হয়নি।
মৃত্যু তোমার সাথে পেরে উঠছে না, বিড়বিড় করে বলল আখমত ইয়াজিদ।
কিন্তু বুঝতে পারছ তো, ব্যঙ্গের সুরে প্রশ্ন করল খালেদ ফৌজি, এখানে এসে নিজের মৃত্যু পরোয়ানায় সই করেছ তুমি?
আমি অন্ধ হলেও, বুদ্ধি হারাইনি।
সুলেমান আজিজ, বিষণ্ণ সুরে বলল আখমত ইয়াজিদ। তার সময়ের শ্রেষ্ঠ আততায়ী, যাকে যমের মতো ভয় করত সিআইএ আর কেজিবি। অসমসাহস আর অতুলনীয় চাতুর্যের পরিচয় দিয়ে গত দুই দশকের বহুল আলোচিত অন্তত পঞ্চাশটা রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, তার কৃতিত্ব ও দাপটের এখানেই সমাপ্তি। কৃতিত্ব ও দাপটের, তবে অস্তিত্বের নয়। নাম-ঠিকানা বদলে তোমাকে ঠাই নিতে হবে ফুটপাতে, মেনে নিতে হবে অন্ধ ভিক্ষুকের অসহায় জীবন। সত্যি, অত্যন্ত দুঃখজনক। আমার কথা বুঝতে পারছ, সুলেমান আজিজ?
কী বলছেন আপনি, জনাব? অবাক হয়ে জকিয়ে থাকল খালেদ ফৌজি।
হ্যাঁ, লোকটা আগেই মারা গেছে। ইয়াজিদের চেহারায় ধীরে ধীরে তৃপ্তির ভাব ফুটে উঠল। আমাদের ফিইন্যানশিয়াল এক্সপার্টরা ওর বিষয় সম্পত্তি আর ইনভেস্টমেন্ট আমার নামে লিখিয়ে নেবে। ওকে রাস্তার মোড়ে বসিয়ে দিয়ে, ওর ওপর চব্বিশ ঘণ্টা নজর রাখার ব্যবস্থা হবে। জীবনের বাকি কয়টা দিন ভিক্ষা করে কাটবে ওর। আকস্মিক মৃত্যুর চেয়ে অনেক বেশি কঠিন শান্তি সেটা।
আখমত ইয়াজিদের মুখের ওপর হাসল সুলেমান আজিজ। যা শোনাব, আপনি আমাকে সাথে সাথে খুন করবেন, জনাব।
কী শোনাবে।
লেডি ফ্ল্যামবোরা অপারেশন সম্পর্কে ত্রিশ পাতার একটা রিপোর্ট লিখেছি আমি। তাতে আপনার সাথে টপিটজিনের সম্পর্ক, আপনাদের পারিবারিক ইতিহাস ইত্যাদি সবই আছে। রিপোর্টের অনেকগুলো কপি তৈরি করেছি, এই মুহূর্তে সেগুলো বিভিন্ন ইন্টেলিজেন্স হেডকোয়ার্টার ও নিউজ সেন্টারে পড়া হচ্ছে। আমাকে নিয়ে আপনি যাই করুন না কেন, জনাব আখমত ইয়াজিদ, ওরফে মি, পল ক্যাপেসটার, আপনার দিনও শেষ হয়ে এসেছে
হঠাৎ থামল সুলেমান আজিজ,, তার গোটা মাথা যেন প্রচণ্ড ব্যথায় বিস্ফোরিত হলো। খালেদ ফৌজি নিজেকে সামলাতে না পেরে বেমক্কা একটা ঘুসি বসিয়ে দিয়েছে। তার মাথায়। টলতে টলতে পিছিয়ে এল সুলেমান আজিজ প্রায় জ্ঞান হারাবার মতো অবস্থা। আবার তাকে খালেদ আঘাত করতে যাচ্ছে দেখে চিৎকার করল আখমত ইয়াজিদ, থামো, বুঝতে পারছ না, লোকটা মরতে চায়? মিথ্যে ভয় দেখাচ্ছে ও, এই মুহূর্তে যাতে ওকে আমরা খুন করি।
ধীরে ধীরে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ ফিরিয়ে আনল সুলেমান আজিজ। ধীরে ধীরে ঘুরল সে, ইয়াজিদের গলার আওয়াজ লক্ষ করে। খালেদ ফৌজির ঘন ঘন নিঃশ্বাসের শব্দও শুনতে পেল সে।
সামনের দিকে সামান্য ঝুঁকল সুলেমান আজিজ, আচমকা বা হাত বাড়িয়ে খপ করে খামচে ধরল আখমতের ডান হাত। খালি হাতটা উঠে গেছে পিঠের ওপর, ঘাড়ের পেছনে।
খুনির নিচে, শিরদাঁড়ার সাথে সাদা সার্জিক্যাল টেপ দিয়ে আটকানো ছুরিটা তার হাতে চলে এল। গুপ্তঘাতকরাই এ ধরনের ছুরি ব্যবহার করে, এমনভাবে তৈরি করা হয়, যাতে মেটাল ডিটেকটরের ধরা না পড়ে। বিদ্যুৎবেগে ছুরি ধরা হাতটা নামিয়ে আনল. সে, তারপর ঢুকিয়ে দিল ছুরিটা ইয়াজিদের বুকে, আঠারো সেন্টিমিটার লম্বা ব্লেডটা আমুল গেঁথে গেল বুকের খাঁচার নিচে।
ধাক্কা খেয়ে মেঝে থেকে শূন্যে উঠে পড়ল আখমত ইয়াজিদ। বিস্ময় ও আতঙ্কে বিস্ফারিত হয়ে উঠল পল ক্যাপেসটারের চোখ জোড়া। গলা থেকে বেরোল আহত পশুর গোঙানি।
বিদায়, নরকের কীট!! হ্যাঁচকা টানে ছুরিটা বের করল সুলেমান আজিজ, খালেদ ফৌজির নিঃশ্বাসের শব্দ লক্ষ করে ঝট করে ঘুরল। ছুরিটা জায়গা মতো লাগল না, প্রতিপক্ষের নাকের পাশে মাংস দুভাগ করে দিল।
সুলেমান আজিজ জানে, খালেদ ফৌজি ডান-হাতি, সাথে সব সময় একটা আগ্নেয়াস্ত্র রাখে, বাম বগলের নিচে পুরনো একটা নাইন মিলিমিটার ব্লগার। তার গায়ে ঢলে পড়ল সে, মৌলবাদী আতঙ্কবাদী নেতাকে আঁকড়ে ধরে থাকল, সেই সাথে চেষ্টা করল মোক্ষম কোথাও ছুরিটা ঢোকাতে।
অন্ধ বলে দেরি করে ফেলল সে। ল্যগারটা খালেদ ফৌজির হাতে চলে এসেছে। তার হৃৎপিণ্ডে সুলেমান আজিজের ছুরি ঢোকার পূর্ব মুহূর্তে লুগারের মাজল থেকে আগুনের ফুলকি ছুটল। পেটে দুটো বুলেট নিয়ে খালেদকে ছেড়ে দিল সুলেমান আজিজ। টলতে টলতে পিছিয়ে এল খালেদ, বুকে বিদ্ধ ছুরিটার হাতল ধরে আছে দুহাতে। চোখ উল্টে পেল তার, ধপাস করে পড়ল মেঝের ওপর ইয়াজিদের দেহ থেকে সামান্য দূরে।
ধীরে ধীরে হাঁটু দুটো ভাজ হলো সুলেমান আজিজের। মেঝের ওপর শুয়ে পড়ল সে। আশ্চর্য, কোথাও কোনো ব্যথা নেই তার।