বিদায়, হযরত। আপনার কথা আমি কখনও ভুলব না।
প্রতিজ্ঞা রক্ষা কোরো, বিশ্বস্ত বৎস। শিষ্যদের মধ্যে তুমিই আমার সবচেয়ে প্রিয়। বেহেশতের বাগানে আবার আমাদের দেখা হবে।
দ্রুত ঘুরল ইবনে, হন হন করে ফিরে এল গাড়ির কাছে। স্থির পাথরের মতো দাঁড়িয়ে থাকল সুলেমান আজিজ, একসময় দূরে মিলিয়ে গেল ইঞ্জিনের আওয়াজ। এবার সে ধীর পায়ে গেটের দিকে এগোল।
এই যে, অন্ধ, থামো ওখানে! নির্দেশ দিল একজন গার্ড।
আমি আমার ভাগ্নের সাথে দেখা করতে এসেছি। আমার ভাগ্নে, আখমত ইয়াজিদ।
গার্ড তার এক সঙ্গীর উদ্দেশে মাথা ঝাঁকাল। গার্ডহাউসে ঢুকে আবার বেরিয়ে এল সঙ্গী, হাতে বিশজনের একটা তালিকা।
বলছেন মামা। কী নাম আপনার?
ছদ্মবেশী হিসেবে জীবনের শেষ অভিনয়টা উপভোগ করছে সুলেমান আজিজ। পুরনো উপকারের শোধ চেয়ে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক কর্নেলের কাছ থেকে কিছু লোকের একটা তালিকা পেয়েছে সে, ইয়াজিদের ভিলায় যাদের প্রবেশাধিকার আছে। তালিকা কে এমন একজনকে বেছে নিয়েছে, সাথে সাথে তার সাথে যোগাযোগ করার উপায় নেই।
মোস্তফা মাহফুজ।
এখানে আপনার নাম আছে তা ঠিক, তবে পরিচয়পত্র দেখাতে হবে। সুলেমান আজিজের জাল করা কাগজপত্র পরীক্ষা করল গার্ড, ব্যান্ডেজ ঢাকা চেহারার সাথে ফটোর মিল খোঁজার ব্যর্থ চেষ্টা করল সে।
আপনার মুখের এই অবস্থা হলো কী করে?
আল মনসুরা বাজারে একটা গাড়ি-বোমা ফেটেছে, শোনোনি?
শুনব না কেন! রাগের সাথে গার্ড। ফাটিয়েছে তো আপনার ভাগ্নের লোকেরাই। সঙ্গীর দিকে ফিরল সে, মেটাল ডিটেকটর আওয়াজ না করলে, পথ দেখিয়ে বাড়ির ভেতর দিয়ে এসো।
মেটাল ডিটেকটরে কিছু ধরা পড়ল না।
সামনের দরজা, তৃপ্তির সাথে ভাবল সুলেমান আজিজ। আখমত ইয়াজিদের সাথে দেখা করার জন্য আজ তাকে পেছনের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকতে হবে না। দুঃখ এই যে তাদের দেখা হবার সময় ইয়াজিদের চেহারাটা সে দেখতে পাবে না।
বড় হলঘরে নিয়ে আসা হলো সুলেমান আজিজকে। পাথরের একটা বেঞ্চে বসল
অপেক্ষা করুন এখানে।
সুলেমান শুনতে পেল, গেটে ফিরে যাবার আগে কার সাথে যেন নিচু গলায় ফিসফিস করল গার্ড। কয়েক মিনিট চুপচাপ বসে থাকল সে। তারপর পায়ের আওয়াজ ঢুকল কানে। শব্দটা এগিয়ে আসছে।
হঠাৎ তীক্ষ্ণ, কঠিন একটা গলা শোনা গেল, আপনি?
গলার আওয়াজটা সাথে সাথে চিনতে পারল সুলেমান আজিজ। হ্যাঁ, সহজ সুরে জবাব দিল সে। তোমাকে আমি চিনি?
আমাদের দেখা হয়নি। আমার নাম খালেদ ফৌজি, জনাব ইয়াজিদের বৈপ্লবিক কাউন্সিলের নেতা।
আপনার সম্পর্কে অনেক কথা শুনেছি আমি, সাথে সাথে বলল সুলেমান আজিজ।
ভাবল, তুমি চিরকাল আমার পেছনে লেগে আছ। আমার ভাগ্য ভালো যে চিনতে পারোনি। আপনার সাথে পরিচিত হয়ে গর্ববোধ করছি।
আসুন, সুলেমান আজিজের একটা হাত ধরে বলল খালেদ ফৌজি। আপনাকে আমি জনাব ইয়াজিদের কাছে নিয়ে যাই। তার ধারণা, এখনও আপনি বাগদাদে রয়েছেন মিসরের কাজে। আপনি যে আহত হয়েছেন তিনি বোধ হয় জানেন না।
তিন দিন আগে আমার ওপর হামলা করা হয়েছে, অবলীলায় মিথ্যে বলে গেল সুলেমান আজিজ। আজই সকালে হাসপাতাল থেকে বেরিয়েছি, প্লেন ধরে সোজা চলে এসেছি ভাগ্নের সাথে দেখা করার জন্য।
আপনার এই অবস্থা দেকে দুঃখ পাবেন জনাব ইয়াজিদ। তবে অসময়ে এসেছেন আপনি।
তার সাথে আমার দেখা হবে না?
তিনি নামাজে দাঁড়িয়েছেন।
এত ভোগান্তির মধ্যেও গলা ছেড়ে হেসে উঠতে ইচ্ছে করল সুলেমান আজিজের। ধীরে ধীরে সচেতন হলো সে কামরায় আরেকজন উপস্থিত রয়েছে। কিন্তু তার সাথে আমার দেখা না করলেই যে নয়।
যা বলার আমাকে বলতে পারেন, মাহফুজ। নামটা ব্যঙ্গের সুরে উচ্চারণ করল খালেদ ফৌজি। আপনার কথা জনাব ইয়াজিদের কাছে পৌঁছে দেব আমি।
আখমতকে বলুন, আমি তার মিত্র সম্পর্কে একটা খবর নিয়ে এসেছি?
মিত্র? কে?
টপিটজিন।
নামটা যেন ঘরের বাতাসে অনন্তকাল ধরে ঝুলে থাকল। জমাট বাঁধল নিস্তব্ধতা। তারপর, হঠাৎ সেটা খান খান হলো নতুন একটা কণ্ঠের ভারী আওয়াজে।
মরে গিয়ে দ্বীপটাতেই ভূত হয়ে থাকা উচিত ছিল তোমার, সুলেমান আজিজ, তিরস্কার করল আখমত ইয়াজিদ।
স্থির থাকল সুলেমান আজিজ। আক্রোশ আর ক্রোধের লাগামে ছিল পড়তে দিল, বৃদ্ধি আর সর্বশেষ শক্তিটুকু এই মুহূর্তের জন্য ধরে রেখেছে সে। মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করার কোনো ইচ্ছে তার নেই। এগিয়ে গিয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করবে সে। পঙ্গু, অসহায়, অন্ধকারময় জীবন তার জন্য নয়। প্রতিশোধই হতে পারে জীবনের শেষ অর্জন।
কী করে মরি, জনাব? আপনার সামনে দাঁড়িয়ে শেষবার ক্ষমা না চেয়ে কী করে মরি!
বন্ধ করো তোমার প্রলাপ! ন্যাকামি তোমাকে মানায় না। আবার ব্যান্ডেজ জড়িয়ে আসা হয়েছে। খোলো ওসব! মাহফুজের ছদ্মবেশ নিতে গিয়ে কী কাণ্ড করেছ তুমি নিজেও জানো না। রীতিমতো হাস্যকর লাগছে তোমাকে।
সুলেমান জবাব দিল না। ধীরে ধীরে ব্যান্ডেজটা খুলতে শুরু করল সে। সবটুকু খুলে ফেলে দিল মেঝেতে।
আঁতকে উঠল আখমত ইয়াজিদ। নিজের অজান্তেই এক পা কিছু হটল সে, সুলেমান আজিজের বিকৃত চেহারায় চুম্বকের মতো আটকে থাকল তার দৃষ্টি।
খালেদ ফৌজির গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেল। রক্তাক্ত, ক্ষতবিক্ষত মানুষের শরীর আগেও তাকে অদ্ভুত এক শিহরণ উপহার দিয়েছে।