চোখ থেকে বাইনোকুলার নামিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। গ্লেসিয়ারের নিস্তব্ধতা চারদিক থেকে ঘিরে ধরল তাকে, ঠাণ্ডা আর নির্বিকার। মাথার কাঁচা-পাকা পরচুলা খুলে বরফের ওপর ছুঁড়ে মারল সে। বুট জোড়া খুলল, বুটের ভেতর থেকে বের করল শক্ত মোটা স্পঞ্জ, দৈর্ঘ্য বাড়ানোর জন্য ব্যবহার করতে হয়েছিল। সচেতন, পাশে তার অন্ধভক্ত বন্ধু ইবনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আশ্চর্য মেকআপ, সুলেমান আজি, আপনাকে চেনাই যাচ্ছিল না। লম্বা সে, রোগাটে, পাকানো রশির মতো শরীর, মাথায় বাবরি।
ইকুইপমেন্ট সব তোলা হয়েছে?
জি। আমাদের মিশন কি সাকসেলফুল, সুলেমান আজিজ?
হিসেবে ছোট্ট একটা ভুল হয়েছে। যেভাবেই হোক চূড়া টপকে বেরিয়ে গেছে প্লেন। মহান করুণাময় আল্লাহ হে’লা কামিলকে আরও কয়েক মিনিট হায়াৎ দরাজ করেছেন।
সুলেমান আজিজ, সভয়ে বলছি, আখমত ইয়াজিদ কিন্তু মোটেও খুশি হবেন না।
প্ল্যান মোতাবেকই মারা যাবে হে’লা কামিল, আত্মবিশ্বাসের সাথে বল সুলেমান আজিজ। আমার কাজে কোনো ফাঁক থাকে না।
কিন্তু প্লেনটা যে এখনও উড়ছে!
এমনকি আল্লাহও ওটাকে অনন্তকাল আকাশে রাখতে পারবেন না।
আল্লাহর ব্যর্থতা নিয়ে পরে আলোচনা করা যাবে, নতুন একটা কণ্ঠস্বর শোনা গেল, আগে ব্যাখ্যা করো তুমি কেন ব্যর্থ হলে? চাপা, ক্রুদ্ধ গর্জনের মতো শোনাল কথাগুলো।
ঝট করে ঘুরল সুলেমান আজিজ, মোহাম্মদ ইসমাইলকে অদূরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার পিত্তি জ্বলে গেল। শিশুসুলভ নিরীহ ভাব ফুটে আছে প্রায় গোল চেহারায়। কালো মুক্তোর মতো একজোড়া চোখ। শুধু ঘন ভ্রু জোড়া একজন পেশাদার খুনির চেহারাতেই যেন বেশি মানায়। দৃষ্টি কেমন যেন আচ্ছন্ন, যেন শুধু ছুঁয়ে যায়, গভীরে প্রবেশ করতে পারে না। সুলেমান আজিজের জানা আছে, এ লোক সহজে খুন করতে ভালোবাসে, কঠিন পরিশ্রমের মধ্যে যেতে চায় না, জানে না হত্যাকাণ্ডকে শিল্পের পর্যায়ে তোলা সম্ভব। সে আরও জানে, মোহাম্মদ ইসমাইলের বিরক্তিকর উপস্থিতি না মেনে নিয়ে তার কোনো উপায় নেই। কায়রো শহরের একজন মোল্লা সে, সুলেমান আজিজের ঘাড়ে প্রায় জোর করে তাকে চাপিয়ে দিয়েছে আখমত ইয়াজিদ। গোড়া মৌলবাদীকে বড় বেশি পছন্দ আর বিশ্বাস করে সে। অবিশ্বাস না করলেও সুলেমান আজিজকে নিয়ে চিন্তিত মনে হয় তাকে। সুলেমান আজিজ, মৌলবাদী রাজনৈতিক নেতাদের যথাযযাগ্য সম্মান দেয় না, তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে সব সময় কড়া সমালোচনা করে, ইত্যাদি লক্ষ করে সতর্ক হবার প্রয়োজন বোধ করেছে সে। সেই সতর্কতারই ফলশ্রুতি মোহাম্মদ ইসমাইল। তার চোখের সামনে, তার পরামর্শ নিয়ে কাজ করতে হয় সুলেমান আজিজকে। কোনো রকম প্রতিবাদ না করেই মোহাম্মদ ইসমাইলকে গ্রহণ করেছে সুলেমান আজিজ। ছলচাতুরি তার মজ্জাগত, মোহাম্মদ ইসমাইল নিজেও জানে না সুলেমান আজিজের পক্ষে তথ্য সরবরাহকারী হিসেবে ভূমিকা রেখে যাচ্ছে সে।
শান্তভাবে পরিস্থিতিটা ব্যাখ্যা করল সুলেমান আজিজ। যান্ত্রিক ব্যাপারে অনেক ধরনের বিচ্যুতি ঘটতে পারে। তবে যা ঘটতে পারে সবই ধারণার মধ্যে ছিল। ঘাবড়াবার কোনো কারণ নেই। অটোমেটিক পাইলট মেরুর দিকে একটা কোর্সে লক করা আছে। আকাশ সময় খুব বেশি হলে আর মাত্র নব্বই মিনিট অবশিষ্ট আছে।
কিন্তু তার আগেই যদি ককপিটের লাশগুলো কেউ দেখে ফেলে? আর যদি আরোহীদের মধ্যে কেউ প্লেন চালাতে জানে? মোহাম্মদ ইসমাইল নাছোড়বান্দা।
আরোহীদের ব্যাকগ্রাউন্ড স্টাডি করা হয়েছে। প্লেন চালানোর অভিজ্ঞতা কারও নেই। তাছাড়া রেডিও আর নেভিগেশন ইনস্ট্রুমেন্ট চুরমার করে দিয়েছি আমি। কেউ যদি প্লেনটাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে চায়, কোথায় আছে বা কোথায় যাচ্ছে কিছুই টের পাবে না। চিরকালের জন্য আর্কটিক সাগরে হারিয়ে যাবে হে’লা কামিল আর তার জাতিসংঘের হোমরাচোমরা শয্যাসঙ্গীরা।
বলতে চাইছ ওদের বাঁচার কোনো উপায়ই নেই?
নেই, দৃঢ়কণ্ঠে বলল সুলেমান আজিজ। একেবারেই নেই।
০৫. একটা সুইভেল চেয়ার
০৫.
একটা সুইভেল চেয়ারে পেশি ঢিল করে দিয়ে বসে আছে ডার্ক পিট, পা দুটো টানটান লম্বা করে দেয়ায় ছয় ফুট তিন ইঞ্চির আকৃতিটা সমান্তরাল তলে রয়েছে এখন। মস্ত একটা হাই তুলল, কালো ঢেউ-খেলানো চুলে আঙুল চালাল বার কয়েক।
একহারা গড়ন ওর, সুঠাম শক্ত পেশি। রোজ দশ মাইল দৌড়ে বা নিয়মিত মুগুর ভেজে যারা স্বাস্থ্য তৈরির জন্য গলদঘর্ম হয় তাদের দলে পড়ে না ও। বছরের বেশির ভাগই ঘরের বাইরে থাকে, ঘুরে বেড়ায় পাহাড়-পর্বত বন-জঙ্গল আর মরুভূমিতে, রোদে পুড়ে অনেককাল আগেই তামাটে হয়ে গেছে গায়ের চামড়া। গভীর সবুজ চোখ দুটোয় উষ্ণ এবং নিষ্ঠুর অনুভূতি খেলা করে একই সঙ্গে। কিন্তু ঠোঁটের কোণে সব সময় একটা হাসি।
জীবনযাপনে আশ্চর্য একটা সাবলীল ভঙ্গি আছে পিটের, হীনম্মন্যতায় ভোগে না কখনও, যে কোনো পরিবেশে ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্যে সপ্রতিভ ও সহজ হতে পারে। অভিজাত আর প্রভাবশালী মহলে অবাধ যাতায়াত ওর। যেকোনো বিষয়ে, সংশ্লিষ্ট পাত্র বা পাত্রী যদি কঠিন হয়, তার প্রতি আকর্ষণ বোধ করে ও।
এয়ারফোর্স একাডেমি থেকে পাস করা সন্তান পিট, মেজর পদে উন্নীত হয়েছিল; প্রায় ছয় বছর হতে চলল ন্যাশনাল আন্ডারওয়াটার অ্যান্ড মেরিন এজেন্সি (নুমা)-তে বিশেষ প্রজেক্ট ডিরেক্টর হিসেবে ধারে কাজ করছে। বাল্যবন্ধু অ্যাল জিওর্দিনোর সঙ্গে পৃথিবীর সব কয়টি সাগর-মহাসাগর চষে বেরিয়েছে পিট, কী পানির উপরে কী নিচে; অনেক মানুষ যে অভিজ্ঞতা সারা জীবনেও অর্জন করতে পারে না, তার দশগুণ বেশি রোমাঞ্চ ও অর্জন করেছে গত অর্ধ দশকে। নিউ ইয়র্কের নিচে হারিয়ে যাওয়া একটা জায়গা থেকে ম্যানহাটন লিমিটেড এক্সপ্রেস ট্রেন খুঁজে বের করেছে সে, সেইন্ট লরেন্স নদীর তলদেশ থেকে জীবিত এক হাজার যাত্রীসহ জাহাজ এম্পায়ার অব দ্য আইল্যান্ড উদ্ধার করেছে। হারিয়ে যাওয়া নিউক্লিয়ার সাবমেরিন স্টারবাককে প্রশান্ত মহাসাগরের তলদেশ থেকে খুঁজে বের করেছে, পিট, ক্যারিবিয়ান সাগরের তলদেশে ভুতুড়ে জাহাজ। সাইক্লপ-এর সমাধি আবিষ্কার করেছে সে। ও হ্যাঁ, টাইটানিক জাহাজ উত্তোলনের পেছনেও তার অবদান ছিল।