টপিটজিনের কালো হাতে খেলনা পুতুল হয়ে উঠলেন দো লরেঞ্জো। দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ল খবরটা, সেনাবাহিনী নিরীহ নারী ও শিশুদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে। আর যায় কোথায়, রাজধানী মেক্সিকো সিটিসহ বড় বড় সব শহরে আগুন জ্বলে উঠল। পুলিশ, সরকার সমর্থক আর সেনাবাহিনীর সাথে দাঙ্গা বেঁধে গেল উত্তেজিত জনতার। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে বাধ্য হয়ে সেনাবাহিনীকে প্রত্যাহার করে নিলেন প্রেসিডেন্ট। হোয়াইট হাউসে বিশেষ বার্তা পাঠিয়ে নিজের অক্ষমতার কথা জানিয়ে দিলেন তিনি। দুঃখ করে বললেন, সেনাবাহিনীর অনেক লোকও মিছিলে যোগ দিয়েছে।
সমস্ত বাধা নির্মূল করে নিয়ে রিয়ো গ্ল্যান্ডের দিকে ছুটল উন্মত্ত জনতা।
গোটা অপারেশনটা সূচারুভাবে পরিচালনা করার জন্য প্রফেশনাল প্ল্যানারদের ভাড়া করেছে ক্যাপেসটার পরিবার। রবার্ট ক্যাপেসটারের অনুসারী ও কর্মীবাহিনী পাঁচ বর্গকিলোমিটার জায়গা নিয়ে একটা তাবু শহর তৈরি করল, সারি সারি রান্নাঘর থাকল সেখানে, খাবার পরিবেশনের জন্য নিয়োগ করা হলো কয়েক হাজার লোকে। পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থায় কোনো ত্রুটি থাকল না, ভিড়ের চাপে ও সক দুর্ঘটনায় আহতদের চিকিৎসা করার জন্য রাস্তার ঘারে তাবুর ভেতর তৈরি থাকল মেডিকেল ইউনিটগুলো। লাখ লাখ মানুষের মিছিল ও সমাবেশের কথা মনে রেখে সম্ভাব্য সমস্ত সদস্য সুরাহা করার ব্যবস্থায় কোনো ত্রুটি নেই। জনতার স্রোতে এমন মানুষের সংখ্যাও কম নয়, যারা এত উন্নতমানের খাবার জীবনে আর কখনও খায়নি বা এ ধরনের সযত্ন চিকিৎসা পায়নি। শুধু রাস্তার ধুলো আর গাড়ির ধোঁয়া নিয়ন্ত্রণ করা গেল না।
নদীর কিনারা ব্যানার দিয়ে সাজানো হয়েছে। সেগুলোর লেখা, আমেরিকা আমাদের মাটি চুরি করেছে,
আলেজকান্দ্রিয়া লাইব্রেরির মালিক মেক্সিকানরা ইত্যাদি। শ্লোগানগুলো ইংরেজি, স্প্যানিশ ও প্রাচীন নাহুয়াটল ভাষায় উচ্চারিত হলো। জনসমুদ্রের ভেতর উপস্থিত হলো টপিটজিন, বজ্রকণ্ঠে আমেরিকার বিরুদ্ধে বিষোদগার করল সে। প্রচণ্ড আবেগ ও উত্তেজনায় ফুঁসে উঠল জনতা।
রোমা শহরে জড়িয়ে পড়ল আতঙ্ক। শহরের অধিবাসীরা ভয়ে রাজ্যের ভেতর দিকে সরে গেল। বিভিন্ন সংবাদ সংস্থা ও টিভিনেটওয়ার্কের কর্মীরা ভিড় করল সীমান্তে। চব্বিশটা টিভি-ক্যামেরা নিয়ে ভ্যান ও ট্রাকের একটা বহর থেমেছে নদীর কিনারায়, সীমান্তের ওপারে যা ঘটছে তার ছবি তুলতে ব্যস্ত ক্যামেরাম্যানরা।
মেক্সিকোর দিকেও, সমাবেশের ছবি তোলা হচ্ছে, সাক্ষাৎকার নেয়া হচ্ছে লোকজনের। সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে কী বলতে হবে, প্রত্যেক পরিবারপ্রধানকে ভালোভাবে শিখিয়ে-পড়িয়ে রেখেছে টপিটজিনের রাজনৈতিক কর্মীরা। চোখে পানি নিয়ে পরিবারের কর্তারা বলছে, তারা ক্যালিফোর্নিয়া, আরিজোনা, নিউ মেক্সিকো আর টেক্সাসে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে চায়। কর্তার সুরে সুর মেলাল ক্রন্দনরতা স্ত্রী ও কন্যা। সারা দুনিয়ার টিভি নিউজে দেখানো হলো সেসব দৃশ্য।
গম্ভীর আর অচঞ্চল থাকল শুধু মার্কিন সীমান্ত টহল-বাহিনী। গুজব আগেই ছড়িয়ে পড়েছিল, তারা জানত একটা হুমকি মোকাবিলা করতে হতে পারে। তাদের সবচেয়ে বড় ভয়টাই বাস্তব চেহারা নিয়ে সামনে হাজির হয়েছে। নিজেদের দায়িত্ব থেকে তারা বিচ্যুত হবে না, অপেক্ষা করছে নির্দেশের।
সীমান্ত টহল-বাহিনীকে অস্ত্র তাক করার নির্দেশ দেয়া একটা দুর্লভ ঘটনা। বেআইনি অনুপ্রবেশকারীর সাথে মানবিক আচরণ করে তারা, সীমান্ত রেখার ওপারে আবার তাকে চলে যেতে বলার সময় ভদ্র ব্যবহার করে। আজ তারা নদীর কিনারায় অবস্থান গ্রহণ করেছে। তাদের অটোমেটিক রাইফেল ও বিশটা ট্যাংক নদীর ওপারে, মেক্সিকোর দিকে তাক করা।
সৈনিকরা সবাই তরুণ হলেও সম্মুখযুদ্ধে যথেষ্ট অভিজ্ঞ। মুশকিল হলো, তারা কেউ নিরস্ত্র সিভিলিয়ানদের সাথে যুদ্ধ করেনি। অস্বস্তি বোধ করার সেটাই কারণ।
কমান্ডিং অফিসার, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কার্টিস চ্যান্ডলার, ট্যাংকে ও আমারড কার দিয়ে ব্যারিকেড তৈরি করেছেন ব্রিজের ওপর। তবে এ-ধরনের বাধা সম্পর্কে আগেই ধারণা করেছিল টপিটজিন। নদীর কিনারায় গিজ গিজ করছে নানা আকৃতির ছোট বোট, কাঠের ভেলা, ট্রাকের টিউব। দুশো মাইলের মধ্যে ছোট নৌ-যান, যা পাওয়া গেছে সব জড়ো করা হয়েছে সীমান্ত বরাবর। নদীর ওপর রশি ফেলা হয়েছে, যারা সাঁতরে পার হবে তাদের জন্য। আর আছে বাঁশের তৈরি সাঁকো। জনতার প্রথম মিছিলটা ওগুলো বয়ে নিয়ে যাবে ওপারে।
প্রথম ধাক্কায় জেনারেল কার্টিসের ইন্টেলিজেন্স অফিসাররা হিসাব করল, বিশ হাজার লোক নদী পেরোবে। এই হিসেবে শুধু জল্যানে করে যারা আসবে তাদের সংখ্যা ধরা হয়েছে। সাঁতার কেটে কত আসবে বলা সম্ভব নয়। তার একজন মেয়ে এজেন্ট একটা ডাইনিং ট্রেইলারে ঢুকে টপিটজিনের সহকারীদের কথাবার্তা শুনেছে। রেডিওযোগে পাঠানো মেসেজে জানিয়েছে সে, সন্ধ্যার পর জনতার উদ্দেশে ভাষণ দেবে তাদের আধুনিক আযটেক দেবতা। টপিটজিনের সেই ভাষণ শুনে মেক্সিকানরা উন্মাদ হয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ভাষণ থামার পরপরই শুরু হবে সীমান্ত পেরোনোর কাজ। তবে কোনো দিন সন্ধ্যার পর তা সে জানতে পারেনি।