বুঝতে পারছি, আমার ভাষণের ভাবটুকু ধার করছো তুমি।
ভাইয়ের কাছ থেকে ধার করার লজ্জা কী। মুখে চামচ ভর্তি ক্যাভিয়ার পুরুলো রবার্ট। ভারি মজার জিনিস। ট্রাক বোঝাই করে ক্যাভিয়ার দাও, আমার অরুচি হবে না। লাইব্রেরির গুপ্তধন দখল করলাম, তারপর কী?
আমি শুধু ম্যাপগুলো চাই। বাকি যা কিছু সরিয়ে আনা যাবে, দুচারটে পারিবারিক মিউজিয়ামের জন্য রেখে, কালোবাজারে সব বিক্রি করে দেয়াই ভালো। তুমি কী বলো?
এক মুহূর্ত চিন্তা করে রবার্ট বলল, তাই হবে।
ট্রে হাতে ফিরে এল ওয়েটার। ট্রে-তে গ্লাস, ব্র্যান্ডির বোতল আর সিগারেট বাক্স রয়েছে।
ধীরে সুস্থে একটা সিগারেট ধরাল পল। ধোঁয়া ছেড়ে চোখ কুঁচকাল, সে, ভাইয়ের দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকাল। লাইব্রেরির সম্পদ কীভাবে তুমি দখল করবে ভেবেছ কিছু?
আমার প্ল্যান ছিল, ক্ষমতায় আসার পর নিরস্ত্র জনতাকে সাথে নিয়ে সীমান্ত পথে। আমেরিকার দিকে মিছিল করে যাব। ক্ষমতায় যাবার আগে একটা রিহার্সেল হয়ে গেলে মন্দ কী। গ্লাসের ভেতর ব্র্যান্ডিটুক ঘন ঘন ঢালল রবার্ট। আমার রাজনৈতিক দলের কর্মীরা শহরের বস্তিবাসী আর গ্রামের বেকার চাষিদের উত্তেজিত করবে। সীমান্তের দিকে রওনা হবার জন্য প্রত্যেক লোককে পথ খরচা দেয়া হবে। অবশ্য, গরিব মানুষদের মনে একবার দেশপ্রেমের আগুন ধরিয়ে দিতে পারলে আর কিছু লাগে না। দূর-দূরান্ত থেকে হাজার হাজার, লাখ লাখ মানুষকে নিয়ে আসার জন্য ট্রাক আর বাসের ব্যবস্থা করা হবে। পাঁচ থেকে সাত লাখ লোক, রিয়ো গ্র্যান্ডে, আমাদের তীরে, অনায়াসে জড়ো করতে পারব আমি।
আমেরিকানরা বাধা দেবে না?
টেক্সাসের প্রতিটি সৈনিক, সীমান্তরক্ষী আর শেরিফ অসহায় দর্শকের মতো দাঁড়িয়ে থাকবে, মিছিল বা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে পারবে না। প্রথম সারিতে মহিলা আর শিশুদের রাখব আমি, ওরাই সবার আগে ব্রিজ আর নদী পেরোবে। আমেরিকানরা আধ-মাতাল বা বলতে পারো ভাবপ্রবণ জাত। ভিয়েতনামে গ্রামবাসীদের খুব করতে পারলেও, নিজেদের দোরগোড়ায় নিরস্ত্র শিশু ও মহিলাদের পাইকারি হারে খুন করতে পারবে না। দুনিয়াজুড়ে অমানবিক বলে নিন্দা করা হবে, ওদের এই ভয়টারও সুযোগ নেব আমি। গুলি করার নির্দেশ দেয়ার সাহস করবে না প্রেসিডেন্ট। আর একবার সীমান্ত পেরোতে পারলে, লাখ লাখ মানুষ চারদিকে ছড়িয়ে পড়বে, কে ওদেরকে ঠেকায়! রোমায় পৌঁছানো পানির মতো সহজ। যে পাহাড়ে গুপ্তধন আছে সেটা তারা ঘিরে ফেলবে।
আর টপিটজিন তাদেরকে নেতৃত্ব দেবে?
আর আমি তাদেরকে নেতৃত্ব দেব।
কিন্তু চেম্বারটা কতক্ষণ তুমি দখল করে রাখতে পারবে? প্রশ্ন করল পল।
তাতে সময় যাই লাগুক, ওখানে আমরা টিকে থাকতে পারব।
কয়েক সপ্তাহ লাগতে পারে, চিন্তিতভাবে বলল পল। অত সময় তুমি পাবে না, রবার্ট। আমেরিকান সৈন্যরা গুলি না করেও জনতাকে ছত্রভঙ্গ করে দিতে পারবে। কয়েক দিনের মধ্যে মেক্সিকানদের সীমান্তের দিকে ঠেলে দেবে তারা।
হাসল রবার্ট। কিন্তু আমি যদি লাইব্রেরির সমস্ত সম্পদ পুড়িয়ে দেয়ার হুমকি দিই? একটা ন্যাপকিন তুলে নিয়ে আলতো ভাবে ঠোঁট মুছল সে। ইতিমধ্যে বোধ হয় আমার জেটে ফুয়েল ভরা হয়ে গেছে। মেক্সিকোয় ফিরে গিয়ে আমি বরং কর্মীদের নির্দেশ দিই।
রবার্টের দিকে তাকিয়ে হাসতে লাগল পল। প্ল্যানটা সত্যি ভালো। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে তোমার সাথে একটা চুক্তিতে আসতে বাধ্য হবে আমেরিকানরা। সত্যি খুব ভালো লাগছে।
আমার আরও বেশি ভালো লাগছে, এই ব্রিটিশ অভ্যুত্থানের পর এত বড় জনগোষ্ঠী আর আমেরিকার মাটিতে অনুপ্রবেশ করেনি।
৭০. উত্তর মেক্সিকোর মানুষ
৭০.
প্রথম দিন তারা এক হাজার দুহাজার করে এল, পরদিন এল দশ হাজার বিশ হাজার করে। গোটা উত্তর মেক্সিকোর মানুষ উত্তেজনায় টগবগ করে ফুটছে, শুরু হয়ে গেছে ব্যানার আর ফেস্টুন নিয়ে কে কার আগে যোগ দেবে তারই তীব্র প্রতিযোগিতা। প্রতিটি ব্যানারে আটেক দেবতার পাশে রয়েছে টপিটজিনের বিশাল প্রতিকৃতি, নিচে লেখা-দেবতাদের আশীর্বাদ পুষ্ট মেক্সিকোর ত্রাণকর্তা টপিটজিনের ডাকে সাড়া দিন, দেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে যোগ দিন। সীমান্তের দিকে মানুষের যেন ঢল নেমেছে। হাজার হাজার বাস আর ট্রাকভর্তি লোকজন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে রওনা হয়ে গেছে। সমস্ত যানবাহন আর মিছিলের একটাই গন্তব্য-রোমার উল্টোদিকে, নদীর আরেক ধারে, ধুলো ঢাকা মিগুয়েল এলমান শহর। রাস্তায় রাস্তায় যানজট লেগে গেল। ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা অচল হয়ে পড়ার রিজার্ভ পুলিশ বাহিনীকে ডেকে পাঠানো হলো, কিন্তু সংখ্যায় কম বলে মিছিলের স্রোতে খড়কুটোর মতো ভেসে গেল তারাও। সীমান্তরক্ষীরা সংখ্যায় আরও কম, নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করা ছাড়া তাদেরও কিছু করার থাকল না।
জরুরি মিটিং ডাকলেন প্রেসিডেন্ট দো লরেঞ্জো। সিদ্ধান্ত হলো, যেকোনো ভাবে এই জনস্রোতকে থামাতে হবে। সেনাবাহিনীকে তিনি নির্দেশ দিলেন, রাস্তা বন্ধ করো। কিন্তু সেনাবাহিনী দেখল, এর চেয়ে বরং জলোচ্ছাস থামানো অনেক সহজ। সমস্ত প্রচেষ্টা যখন ব্যর্থ হলো, বাধ্য হয়ে গুলি চালাল সৈনিকরা। সামনের মিছিল থেকে পঁয়তাল্লিশজন মানুষ লুটিয়ে পড়ল রাস্তার ওপর, বেশির ভাগই নারী ও শিশু। লাশের ওপর দিয়ে ধেয়ে এল উত্তেজিত জনতা, যেন মৌমাছির চাকে ঢিল পড়েছে।