আমাদের নিচে মাটি।
মাটি?
সরাসরি আমাদের নিচে, হাঁপাতে হাঁপাতে বলল মেয়েটা, চোখ পিটপিট করছে। একজন আরোহী আমাকে দেখল।
মাথা নাড়ল। অসম্ভব! সমুদ্রের মাঝখানে থাকার কথা আমাদের। সম্ভবত ফিশিং বোটের আলো দেখেছে সে। আবহাওয়া-সংক্রান্ত গবেষণার জন্য, ক্যাপটেন বলেছেন…
বিশ্বাস না হয় নিজেই দেখো না! তাকে থামিয়ে দিয়ে আবেদনের সুরে বলল অ্যাটেনড্যান্ট। নিচের মাটি দ্রুত উঠে আসছে। আমরা বোধ হয় ল্যান্ড করতে যাচ্ছি।
গ্যালির একটা জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়াল, নিচে তাকাল। আটলান্টিকের কালো পানির বদলে সাদা একটা উজ্জ্বল ভাব দেখতে পেল সে। প্লেনের নিচে বরফের বিশাল একটা বিস্তৃতি পেছন দিকে ছুটে যাচ্ছে, খুব বেশি হলে দুশো চল্লিশ মিটার নিচে, নেভিগেশন লাইটের প্রতিফলন পরিষ্কার দেখা গেল। আতকে উঠল, ঘুরে উঠল মাথাটা। এটা যদি ইমার্জেন্সি ল্যান্ডিং হয়, ক্যাপটেন মেইন কেবিনের ক্রুদের জানাননি কেন? সিট বেল্ট বাঁধার বা ধূমপান না করার নির্দেশ দেননি কেন? হতভম্ব চেহারা নিয়ে অ্যাটেনড্যান্টের দিকে ফিরল সে। আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।
জাতিসংঘের প্রায় সর আরোহীই জেগে রয়েছে, পত্রপত্রিকা পড়ছে বা কথা বলছে। শুধু হে’লা কামিল ঘুমিয়ে পড়েছেন। অর্থনৈতিক সেমিনার শেষ করে বিশ্বব্যাংকের হেডকোয়ার্টারে ফিরছে প্রতিনিধিদল, প্লেনের লেজে একটা টেবিলে জড় হয়েছে তারা সবাই। প্রতিনিধিদলের নেতা, অর্থ মন্ত্রণালয়ের সচিব নিচু গলায় কথা বলছেন, থমথম করছে তার চেহারা। মেক্সিকোর অর্থনীতি বিধ্বস্ত হয়ে গেছে, গোটা দেশ দেউলিয়া হতে আর বেশি দেরি নেই, অথচ আর্থিক সহায়তা লাভেরও কোনো আশা কেউ তাঁরা দেখতে পাচ্ছেন না।
ফ্লাইট অ্যাটেনড্যান্ট রুদ্ধশ্বাসে জিজ্ঞেস করল, ইমার্জেন্সি প্রসিডিওর শুরু করা উচিত নয়?
আরোহীদের কিছু জানিয়ো না। অন্তত এক্ষুনি নয়। আগে আমাকে ক্যাপটেনের সাথে যোগাযোগ করতে দাও।
কিন্তু তার কি সময় আছে?
না-জানি না। নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করে মেইন কেবিন ধরে হন হন করে এগোল, আরোহীদের কিছু বুঝতে না দেয়ার জন্য মুখের সামনে একটা হাত রেখে হাই তুলল। সামনের পর্দাটা হ্যাঁচকা টানে সরিয়ে ককপিটের দরজার সামনে থামল সে, হাতল ধরে মোচড় দিল। ভেতর থেকে তালা মারা।
নক করল সে। তারপর ঘুষি মারল। কোনো সাড়া নেই। ক্যাপটেনকে নিয়ে তিনজন রয়েছে ভেতরে, কী করছে তারা? মরিয়া হয়ে দরজার গায়ে লাথি মারল সে। দরজার কবাট হালকা বোর্ড দিয়ে তৈরি, বাইরের দিকে খোলে। দ্বিতীয় লাথিতে সেটা ভেঙে গেল। দোরগোড়া টপকে ভেতরে ঢুকল। ঢুকেই পাথর হয়ে গেল।
অবিশ্বাস, বিস্ময়, ভয় ও আতঙ্ক, বাঁধ ভাঙা পানির মতো একযোগে সবগুলো অনুভূতি গ্রাস করে ফেলল তাকে। ক্রুদের একজন মেঝেতে পড়ে আছে, আরেকজন তার প্যানেলে হুমড়ি খেয়ে রয়েছে। ক্যাপটেন ডেইল লেমকে অদৃশ্য। জেরি অসওয়ার্ল্ডকে টপকাতে গিয়ে তার গায়ে হোঁচট খেল, খালি পাইলটের সিটের ওপর ঝুঁকে উইন্ডশিল্ড দিয়ে বাইরে তাকাল।
পেন্নর নাকের সামনে বিপুল বিস্তার নিয়ে ঝুলে রয়েছে হসজোকাল গ্লেসিয়ারের চূড়া, খুব বেশি হলে মাইল দশেক দূরে। তারার আলোয় সবুজাভ দেখল বরফের গা। কী ঘটতে যাচ্ছে বুঝতে পেরে আতঙ্কে দিশেহারা বোধ করল স্টুয়ার্ড। প্লেন কীভাবে চালাতে হয় সে সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই তার, তবু পাইলটের সীটে বসে কন্ট্রোল কলামটাকে দুহাতে আঁকড়ে ধরল সে। নিজের কথা ভাবছে না, কিন্তু আরোহীদের বাঁচানোর শেষ একটা চেষ্টা তো করতেই হবে। হুলিটাকে নিজের বুকের দিকে টেনে আনার চেষ্টা করল সে।
কিছুই ঘটল না।
কলাম টিল হতে চাইছে না অথচ আশ্চর্য, অলটিমিটারে দেখা গেল প্লেন ধীরে ধীরে হলেও ওপর দিকে উঠছে। আবার হুইলটা নিজের দিকে টানল সে, এবার আরও জোরে। সামান্য একটু কাছে এল। দৃঢ় চাপ অনুভব করে বিস্মিত হলো সে। তার চিন্তাশক্তি স্বাভাবিক নিয়মে কাজ করছে না। অভিজ্ঞতা এতই কম যে বুঝতে পারছে না অটোমেটিক পাইলটের ওপর আসুরিক শক্তি খাটাচ্ছে সে, যেখানে মাত্র পঁচিশ পাউন্ড চাপ-ই ওটাকে নত করতে পারে।
স্বচ্ছ ঠাণ্ডা বাতাসে গ্লেসিয়ারটাকে এত কাছে মনে হলো যেন হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে। থ্রটল সামনের দিকে ঠেলে দিয়ে কলামটাকে আবার কাছে টানল সে। থেমে থেমে, জেদ আর অনিচ্ছার ভাব নিয়ে কাছে এল বটে, কিন্তু আবার পিছিয়ে গেল খানিকটা। যেন যন্ত্রণাকাতর মন্থরতার সাথে ওপর দিকে নাক তুলল প্লেন, বরফ আর তুষার ঢাকা চূড়াটাকে টপকাল মাত্র একশো ফুট ওপর দিয়ে।
.
আসল ডেইল লেমকেকে তার লন্ডন ফ্ল্যাটে খুন করেছে সুলেমান আজিজ। ছদ্মবেশ নেয়ার ব্যাপারে সে একজন জাদুকর, বেচারা লেমকের ফ্ল্যাটে বসেই চেহারা বদলে নিয়েছে। এই মুহূর্তে বরফের রাজ্যে দাঁড়িয়ে রয়েছে সে, চোখে একজোড়া নাইট গ্লাস তুলে তাকিয়ে রয়েছে দূরে। সুমেরুপ্রভা ম্লান হয়ে এলেও আকাশের গায়ে হক্সজোকালের কিনারাগুলো এখনও ঠাহর করা যায়।
উত্তেজনা আর প্রত্যাশায় টান টান হয়ে আছে পরিবেশ। দু’জন টেকনিশিয়ান আলো আর ট্রান্সমিটার বিকন তুলে একটা হেলিকপ্টারে ভরছে বটে, কিন্তু তারাও ঢালের ওপর দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে গ্লেসিয়ারের চূড়ার দিকে। পাথুরে মূর্তির মতো স্থির হয়ে রয়েছে সুলেমান আজিজ, এক দুই করে সেকেন্ড গুনছে, আশা যেকোনো মুহূর্তে আগুনের বিস্ফোরণ দেখতে পাবে। কিন্তু কিছুই ঘটল না।