হেলিকপ্টার খানিকটা ওপরে তুলল পাইলট, ইন্টারন্যাশনাল ব্রিজ ছাড়িয়ে এসে আবার নদীর কাছাকাছি নেমে এল। মেক্সিকোর দিকে নারী-পুরুষ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে গাড়ি ধুচ্ছে, বাগান পরিষ্কার করছে, মাছ ধরার জাল মেরামত করছে, হাঁটু পানিতে দাঁড়িয়ে গোসল করছে অনেকে। আমেরিকার দিকে নদীর পাড় থেকে খাড়া হয়েছে হলদেটে স্যান্ডস্টোন ব্লফ রোমা শহরের মাঝখান পর্যন্ত সেটার বিস্তার। ভবনগুলো বেশ পুরনো, তবে কোনোটাই ভেঙে পড়েনি, কয়েকটার মেরামত দরকার।
ভবনগুলো সম্পর্কে কিছু শোনাবেন নাকি? হার্ব গার্জাকে জিজ্ঞেস করল লিলি।
সামরিক ও বাণিজ্যিক বোট তৈরির যখন হিড়িক পড়ল, সে-সময় অত্যন্ত ব্যস্ত বন্দর ছিল রোমা, লেকচার দিল হার্ব গার্জা। বাড়ি ও ব্যবসাকেন্দ্র তৈরির জন্য সওদাগররা নামি-দামি আর্কিটেক্টদের ভাড়া করে আনে। ওগুলো কম দিন তো টিকল না।
এক-আধটা বিখ্যাত হয়ে ওঠেনি?
বিখ্যাত? হেসে উঠল হার্ব গার্জা। হ্যাঁ, তাও আছে। আঠারোশো সালে তৈরি ওটা। রোজিটাস ক্যানটিনা হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ভিভা জাপাটা ছবিতে। মার্লোন ব্যান্ডো ছিল, রোমায় ভোলা, আপনারা জানেন।
শহরের ওপর উঁচু হয়ে থাকা পাহাড়টাকে চক্কর দেয়ার জন্য পাইলটকে নির্দেশ দিলেন অ্যাডমিরাল। রোমার নাম রোমের অনুকরণে রাখা হয়েছে এই কারণে কী যে। এই শহরটাকেও সাতটা পাহাড় ঘিরে রেখেছে?
নিশ্চয় করে বলা সম্ভব নয়, জবাব দিল হার্ব গার্জা। সাতটা পাহাড়কে আলাদাভাবে আপনি খুঁজেই পাবেন না। চোখে পড়ার মতো চূড়া আছে মাত্র দুটোর, বাকিগুলো পরস্পরের সাথে জোড়া লেগে আছে।
জিওলজি কী বলে? প্রশ্ন করল পিট।
বেশিরভাগ খড়িমাটি বা ওই ধরনের আবর্জনা। একসময় গোটা এলাকা সাগরের নিচে ছিল। মাটির নিচে ফসিল, ঝিনুকের খোল দেদার। কাছাকাছি একটা গ্র্যাভেল পিট আছে, বিভিন্ন জিওলজিক্যাল পিরিয়ডের নিদর্শন ওখানে পেতে পারো। ঠাণ্ডা হয়ে কোথাও বসার সুযোগ দিলে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানাতে পারি তোমাকে।
এক্ষুনি নয়, বলল পিট। এলকায় কোথাও প্রাকৃতিক গুহা নেই?
সারফেসে দেখা যায় না। তার মানে এই নয় যে নদীর নিচে নেই। প্রাচীন সাগর কত গুহা তৈরি করেছিল কে তার হিসাব রাখে, আপার লেয়ারের নিচে সব চাপা পড়ে আছে। ঠিক জায়গাটিতে যথেষ্ট গভীর করে খোঁড়া, প্রচুর সম্ভাবনা বড় আকৃতির একটা লাইমস্টোন ডিপোজিট পেয়ে যাবে তুমি। প্রাচীন ইন্ডিয়ান কিংবদন্তি হলো, মাটির তলায় আত্মারা বসবাস করে।
আত্মা? কি ধরনের আত্মা?
কাঁধ ঝাঁকালো হার্ব গার্জা। প্রাচীন আত্মা, যারা অপদেবতাদের সাথে যুদ্ধ করার সময় মারা গেছে।
নিজের অজান্তেই পিটের বাহু আঁকড়ে ধরল লিলি। পুরনো কোনো শিল্পকর্ম রোমার আশপাশে পাওয়া গেছে?
অল্প কিছু তীর আর বর্শার পাথুরে ডগা, পাথুরে ছুরি আর বোট-স্টোন।
বোট-স্টোন কী জিনিস? প্রশ্ন করল পিট।
ফাঁপা পাথর, আকৃতিতে ঠিক যেন একটা বোটের খোল, জবাব দিল লিলি, ক্রমশ উত্তেজিত হয়ে উঠছে সে। ওগুলোর আদি উৎস সম্পর্কে কারও স্পষ্ট কোনো ধারণা নেই। মনে করা হয়, শখের জিনিস। ইন্ডিয়ানরা ওগুলো ব্যবহার করত ভূত তাড়ানের কাজে। কাউকে ডাইনি বলে সন্দেহ করা হলে, ইন্ডিয়ানরা তার প্রতিমূর্তির সাথে একটা বোট-স্টোন বেঁধে নদীতে ফেলে দিত, তাতে নাকি সমস্ত অপশক্তি থেকে মুক্তি পেত ডাইনি।
পিট আরও একটা প্রশ্ন করল হার্ব গার্জাকে, এমন কিছু পাওয়া গেছে, যেটাকে প্রাচীন বা ঐতিহাসিক বলা যায়?
কিছু কিছু পাওয়া গেছে, তবে মনে করা হয় সেসব নকল।
উত্তেজনা চেপে রেখে লিলি জানতে চাইল, কী ধরনের জিনিস?
তলোয়ার, ক্রস, বর্ষের ভাড়া অংশ, বর্শা দণ্ড, বেশির ভাগই লোহার তৈরি। নদীর কিনারায়, ব্লাফ খুঁড়ে একটা পাথুরে নোঙর পাবার কথাও মনে পড়ছে আমার।
সম্ভবত স্প্যানিশ, মন্তব্য কররেন অ্যাডমিরাল।
মাথা নাড়ল হার্ব গার্জা। স্প্যানিশ নয়, রোমান। স্টেট মিউজিয়ামের অফিসাররা পাত্তা দেয়নি। তাদের ধারণা, ওগুলো ঊনবিংশ শতাব্দীর জালিয়াতি নকল।
পিটের বাহু আরও জোরে চেপে ধরল লিলি। ওগুলো দেখার কোনো সুযোগ আমি পাব? ব্যাকুলকণ্ঠে জিজ্ঞেস করল সে। নাকি সব হারিয়ে গেছে?
জানালার দিকে হাত বাড়িয়ে নিচের রাস্তাটা দেখিয়ে দিল হার্ব গার্জা, রোমা থেকে উত্তর দিকে চলে গেছে। ঘাবড়ানোর কোনো কারণ নেই, সবই আপনারা ওখানে পাবেন। একজন লোকের কাছে সব জমা আছে, বেশির ভাগ তারই খুঁজে পাওয়া। বুড়ো টেক্সান স্যাম ট্রিনিটিকে এখানকার লোকেরা পাগলা স্যাম হিসেবে চেনে। এদিকে পঞ্চাশ বছর ধরে খোঁড়াখুঁড়ির কাজ করছে সে। যিশুর কিরে খেয়ে দাবি, করে এখানে নাকি রোমান সেনাদের একটা বাহিনী তাবু ফেলেছিল। ঘোট একটা গ্যাস স্টেশন আর দোকান আছে তার, পেছনের ঘরটার নাম দিয়েছে রোমান মিউজিয়াম।
বুড়ো স্যামকেই তো আমরা খুঁজছি, মৃদু হেসে বলল পিট। পাইলটের দিকে ফিরল ও। স্যামের বাড়ির কাছে নামতে পারবেন? ওর সাথে আমাদের কথা হওয়া দরকার।
.
৬৬.
বিশাল একটা সাইনবোর্ড, ক্ষতবিক্ষত একজোড়া কাঠের ওপর দাঁড়িয়ে আছে পেছন দিকে কাত হয়ে। রুপালি জমিতে বড়বড় লাল হরফে লেখা স্যামের রোমান সার্কাস অনেক কষ্টে পড়া গেল। সামনে একটা তিনকামড়ার দোতলা বাড়ি, সামনের ঘরটা দোকান। দোকানের গায়ে, এক পাশে, আরও একটা সাইনবোর্ড টাঙানো রয়েছে, তাতে লেখা, আটচল্লিশ সেন্টে এক লিটার মেথানল মেশানো ফুয়েল কিনুন। ঠাণ্ডা পানীয় থেকে শুরু করে চকোলেট, মনিহারি দ্রব্যাদি, সবই পাওয়া যায় এখানে।