বেপরোয়া হয়ে উঠল সুলেমান আজিজ, অসহায় জীবনকে সে ভীষণ ভয় করে। টলমল করতে কতে দাঁড়াল সে, কিন্তু পড়ে গেল। এই সময় তার দুই কাঁধ আঁকড়ে ধরল একজোড়া হাত।
নড়াচড়া করবেন না, হযরত। আওয়াজ করলে আমরা ধরা পড়ে যাব, ইবনের ফিসফিসে গলা। আমেরিকানরা আমাদেরকে হন্যে হয়ে খুঁজছে।
আশ্বস্ত হবার জন্য ইবনের হাত দুটো শক্ত করে খামচে ধরল সুলেমান আজিজ। কথা বলার চেষ্টা করল সে, কিন্তু অর্থপূর্ণ কোনো আওয়াজ বেরোলো না গলা থেকে। আহত পশুর মতো গুঙিয়ে উঠল সে। ভেঙে গুঁড়িয়ে গেছে তার চোয়াল, রক্ত জমাট বেঁধে আছে গলার ভেতর আর দাঁতের গোড়ায়।
মাইন টানেলের ভেতর, ছোট একটা চেম্বারে রয়েছি আমরা, নিচু গলায় বলল ইবনে। ওরা খুব কাছাকাছি চলে এসেছিল, তবে তার আগেই একটা দেয়াল গেঁথে ফেলেছি আমি।
মাথা ঝাঁকাল সুলেমান আজিজ, ইবনের কথা বুঝতে পারছে সে।
ইবনে যেন তার মরে কথা টের পেলে গেছে। আপনি মরতে চান, হযরত? না, তা হতে পারে না। কাজ শেষ না করে, আপনি বা আমি, দু’জনের একজনও মরব না। একসাথে যাব আমরা, তবে আল্লাহ যখন চাইবেন তার এক মিনিটও আগে নয়।
হতাশায় নেতিয়ে পড়ল সুলেমান আজিজ। আগে কখনও এমন উদভ্রান্ত হয়নি সে। নিজের ওপর তার এক ফোঁটা নিয়ন্ত্রণ নেই। ব্যথায় পাগল হয়ে যাচ্ছে সে। তার ওপর দুঃস্বপ্নটা থেকে বেরোতে পারছে না-জেলখানার সেলে কড়া পাহারায় আটকে রাখা হয়েছে তাকে, পঙ্গু ও অন্ধ।
মনটাকে শান্ত করুন, জনাব, তার কানে কানে নরম সুরে বলল ইবনে দ্বীপ থেকে পালানোর সময় আপনার সবটুকু শক্তি দরকার হবে।
পাশ ফিরল সুলেমান আজিজ। টানেলের মেঝেতে কোথাও কোথাও পানি রয়েছে, কাঁধের ক্ষতটা ডুবে যাওয়ায় ঠাণ্ডা আরাম লাগল। না চাইলেও, চোখের সামনে ছবির মতো একের পর এক ভেসে উঠল ভীতিকর কয়েকটা দৃশ্য। ঠোঁটে ক্ষীণ হাসি নিয়ে তাকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়ছে ডার্ক পিট। সে দেখতে পেল, তার সামনে পাহাড়ের মতো দৈর্ঘ্য নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে আখমত ইয়াজিদ, তাকে ভেংচাচ্ছে। আক্রোশে চিৎকার করতে ইচ্ছে হলো তা-তুমি আমার সাথে বেঈমানি করেছ। হঠাৎ এক ঝলক আলো দেখতে পেল সুলেমান আজিজ। সেই আলোয় মরে চোখে ধরা পড়ল ভবিষ্যৎ।
মৃত্যু সমাপ্তি নয়। মৃত্যুর পর মানুষের কীর্তি বেঁচে থাকে। সে বেঁচে থাকবে প্রতিশোধের মধ্য দিয়ে। আমি প্রতিশোধের মধ্যে বেঁচে থাকব, কথাটা মনে মনে আওড়াতে শুরু করল সে। একসময় সু-সংহত হরো আর চিন্তাধারা, মানসিক সুস্থতা প্রায় পুরোটাই ফিরে এল।
যে সিদ্ধান্তটা নিতে চেষ্টা করল সুলেমান আজিজ, সেটা হচ্ছে; তার নিজের হাতে প্রথমে কে মারা যাবে-পিট, নাকি আখমত ইয়াজিদ? একা তার পক্ষে কিছু করা সম্ভব নয়। দু’জনকে খুন করার মতো শারীরিক সামর্থ্য তার নেই। ধীরে ধীরে একটা প্ল্যান তৈরি হতে লাগল মাথার ভেতর। প্রতিশোধের ভাগ দিতে হবে ইবনেকেও।
ব্যাপারটা পছন্দ না হলেও, শেষ পর্যন্ত নিজের সাথে আপস করল সুলেমান আজিজ।
কয়োট আর সাপ-দু’জনের একজনকে নিজ হাতে হত্যা করবে সে। বাকি একজন মারা যাবে ইবনের হাতে।
.
৬৪.
স্ট্রেচারে শুয়ে আকাশভ্রমণে রাজি হয়নি পিট। আরামদায়ক একটা এক্সিকিউটিভ চেয়ারে বসে আছে ও, পা তুলে দিয়েছে প্লেনের একটা সিটের ওপর। জানালা দিয়ে চকচকে আন্দিজ পর্বতমালা দেখছে সে। কিছু সময় পর ক্যারিবিয়ান সাগরের ওপর দিয়ে উড়ে যেতে লাগল তারা।
ছোটখাটো বিমানে দীর্ঘদেহী পিটের এমনকি দাঁড়ানোর সুযোগ নেই। আরাম আয়েশের কোনো ব্যবস্থার অবশ্য কমতি নেই।
পিটের বাবা ঠিক কথা বলার মুডে নেই। ভ্রমণের বেশির ভাগ সময় একটা ব্রিফকেস খুলে প্যাডে নোট লিখতে ব্যস্ত থাকলেন সিনেটর পিট।
লেডি ফ্ল্যামবোরোর উনি কীভাবে গেলেন, পিটের এই প্রশ্নের জবাব দেয়ার সময় মুখ তুলে তাকালেন না। প্রেসিডেন্ট আমাকে একটা কূটনৈতিক দায়িত্ব দিয়েছিলেন।
নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকলেন হে’লা কামিলও। প্লেনের ইনফ্লাইট টেলিফোনটা সারাক্ষণ দখল করে রাখলেন তিনি, জাতিসংঘের নিউ ইয়র্ক বিল্ডিংয়ে তার এইডদের একের পর এক নির্দেশ দিয়ে গেলেন। পিটের উপস্থিতি সম্পর্কে তাঁকে সচেতন মনে হলো শুধু চোখাচোখি হবার সময়, প্রতিবার ছোট্ট করে হাসলেন।
কত দ্রুত ওরা ভুলতে পারে- দীর্ঘশ্বাস পেলে পিট ভাবে।
অগত্যা আলেকজান্দ্রিয়া গুপ্তধন নিয়ে চিন্তা করতে লাগল সে। হে’লা কামিল ফোনটা ছালে হেনরি ইয়েজারের সাথে কথা বলতে পারত ও। লাইব্রেরিটা সে খুঁজে পেল কি না কে জানে। তারপর ইচ্ছেটা বাতিল করে দিল, সশরীরে উপস্থিত হয়েই জানা যাবে সব।
আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরির অমূল্য সম্পদগুলো লুকানোর আগে কোনো নদী পাড়ি দিয়েছিলেন ভেনাটর? ইয়েজারের ধারণা, আজ যেটাকে নিউ জার্সি বলা হচ্ছে, সেখানে মেরামত করা হয়েছে সেরাপিসকে। অচেনা নদীটা দক্ষিণে হতে বাধ্য।
জাহাজ বহর নিয়ে গালফ অব মেক্সিকোয় পৌঁছেছিলেন ভেনাটর, সম্ভব? আজ যে স্রোত বইছে, ষোলোশো বছর আগের থেকে নিশ্চই আলাদা। এমন কি হতে পারে না, ভেনিজুয়েলার এরিনকোতে নেমেছিলেন ভেনাটর। নাকি আমাজন?
বেচারা এরিকসন ও কলম্বাসের নাম নেমে আসবে ফুটনোটে।
এনড্রস এয়ারফোঁস বেস্-এ নামল প্লেন। অ্যালুমিনিয়াম টিউবের ভেতর দিয়ে পিটকে নিয়ে নিচে নেমে এল হুইল লাগানো চেয়ারটা। সিঁড়ি বেয়ে নামলেন হে’লা কামিল, পিটকে শুভেচ্ছা জানাবেন। তাকে নিয়ে নিউ ইয়র্ক যাবে প্লেনটা। পিটের কাঁধে একটা হাত রেখে ভদ্রমহিলা বললেন, আমার জীবনে অত্যন্ত উজ্জ্বল একটা স্মৃতি হয়ে থাকবেন আপনি, ডার্ক পিট।