হফসজোকাল গ্লেসিয়ারে একটা বিকন রাখা আছে, সেটা থেকে পাঠানো সঙ্কেত রেডিওতে ধরে, সরাসরি গ্লেসিয়ারের দিকে অটোপাইলট রিসেট করল সুলেমান আজিজ। দ্বীপের মাঝখান থেকে এক হাজার সাতশো সাঁইত্রিশ মিটার উঁচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে হিমবাহ হফসজোকাল। এরপর অলটিচ্যুড সেট করল সে, সংঘর্ষটা যাতে চূড়ার দেড়শো মিটার নিচে ঘটে।
এক এক করে কমিউনিকেশন আর ডাইরেকশন ইন্ডিকেটরগুলো ভাঙল সে। সাবধানের মার নেই, তাই ফুয়েল বিসর্জন দেয়ার কাজটাও শান্তভাবে সারল। হাতঘড়ি দেখল, প্লেনে আর আট মিনিট আছে সে। ট্র্যাপ-ডোর গলে হেল হোল-এ নেমে এল, বিড়বিড় করে গান গাইছে নাকি কলমা পড়ছে সে-ই জানে। মোটা ইলাস্টিকের সোলসহ ফ্রেঞ্চ প্যারাবুট জোড়া আগেই পরে নিয়েছে। ডাফল ব্যাগ থেকে একটা জাম্পস্যুট বের করে ব্যস্ততার সাথে পরে ফেলল, স্কি মাস্ক আর স্টকিং ক্যাপ পরার পর মাথায় আর হেলমেট পরার সুযোগ থাকল না। ব্যাগ থেকে এরপর বেরোল দস্তানা, গগলস আর একটা অলটিমিটার, শেষেরটা কব্জির সাথে স্ট্র্যাপ দিয়ে বেঁধে নিল। প্যারাসুটের প্রধান অংশটি কোমরের কাছে থাকল, বাকিটুকু থাকল শোল্ডার ব্লেডের ওপর। তৈরি হয়ে নিয়ে আবার হাতঘড়ির দিকে তাকাল সে।
এক মিনিট বিশ সেকেন্ড।
এস্কেপ ভোর খুলল সে। সগর্জনে বাতাস ঢুকল হেল হোলে। সেকেন্ডের কাটার ওপর চোখ রেখে কাউন্ট ডাউন শুরু করল সে।
..পাঁচ, চার, তিন, দুই, এক, শূন্য। সরু ফাঁকাটা দিয়ে লাফ দিল সে, পা জোড়া সামনের বিমান যেদিকে ছুটছে সেদিকে মুখ। বাতাসের ঘূর্ণি ধেয়ে আসা বরফ ধসের মতো আঘাত করল মুখে, ছো দিয়ে কেড়ে নিল ফুসফুসের সমস্ত বাতাস। কানের পর্দা ফাটানো গর্জন তুলে এগিয়ে গেল প্লেনটা। পরমুহূর্তে হালকা হয়ে গেল শরীর, দীর্ঘ পতন শুরু হয়ে গেছে।
ব্যাঙের মতো হাত-পা ছড়িয়ে নামছে সুলেমান আজিজ, নিচে ঘোর অন্ধকার ছাড়া কিছুই দেখতে পেল না। সবচেয়ে খারাপ যেটা ঘটতে পারে সেটাই আন্দাজ করে নিল সে। সঠিক জায়গায় পৌঁছতে ব্যর্থ হয়েছে তার সহকারীরা। অন্ধকারে নির্দিষ্ট টার্গেট এলাকা না থাকায় বাতাস কতদূরে বা কোন দিকে তাকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে বোঝার কোনো উপায় নেই। নির্ধারিত জায়গা থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে গিয়ে পড়তে পারে সে, পড়তে চোখা কোনো বরফের মাথায়, কিংবা সরু কোনো গভীর ফাটলের ভেতর। কেউ হয়তো তাকে খুঁজেই পাবে না কোনো দিন।
দশ সেকেন্ডে প্রায় তিনশো ষাট মিটার নেমেছে। আলোকিত অলটিমিটারের ডায়ালে কাঁটা লাল ঘরে পৌঁছতে যাচ্ছে। আর তো দেরি করা যায় না। একটা পাউচ থেকে পাইলট শুটটা বের করে বাতাসে ছুঁড়ে দিল সে। আকাশে নোঙর ফেলল সেটা, মেইন প্যারাস্যুটটাকে টেনে খুলে ফেলল। হাত-পা ছড়ানো ব্যাঙের আকৃতি বদলে গেল, খাড়াভাবে নামছে এখন সুলেমান আজিজ।
হঠাৎ করে আলোর ছোট্ট একটা বৃত্ত তার ডান দিকে মাইলখানেক দূরে পিট পিট করে উঠল। তারপর আকাশে উঠে এল একটা ফ্লেয়ার, স্থির হয়ে ঝুলে থাকল বেশ কয়েক সেকেন্ড। বাতাসের গতি আর দিক বোঝার হলো তার। ডান দিকের স্টিয়ারিং টগল টেনে আলোটার দিকে নামতে শুরু করল সে।
আকাশে আরেকটা ফ্লেয়ার উঠল। মাটির কাছাকাছি বাতাস স্থির হয়ে আছে। এতক্ষণে সহকারীদের পরিষ্কার দেখতে পেল সে। আলোর এক জোড়া সরল রেখা তৈরি করেছে ওরা, আগে দেখা বৃত্তটার দিকে চলে গেছে। স্টিয়ারিং টগল টেনে একশো আশি ডিগ্রি বাঁক নিল সুলেমান আজিজ। মাটিতে নামার প্রস্তুতি শেষ করল। তার সহকারীরা জায়গাটা ভালোই বেছেছে। নরম তুন্দ্রায় পা দিয়ে পড়ল সে, বৃত্তের ঠিক মাঝখানে, খাড়াভাবে। কথা না বলে স্ট্র্যাপগুলো খুলল সে চোখ ধাঁধানো আলোর মাঝখান থেকে বেরিয়ে এসে মুখ তুলল আকাশে।
আকাশ ছোঁয়া হিমবাহের দিকে ছুটে চলেছে প্লেনটা। কী ঘটতে যাচ্ছে সে সম্পর্কে আরোহী বা ক্রুদের কারও কোনো ধারণা নেই। হিমবাহ আর ধাতব মেশিনের মাঝখানের দূরত্ব দ্রুত কমে আসছে।
নিঃশব্দে তাকিয়ে থাকল সুলেমান আজিজ। জেট ইঞ্জিনের আওয়াজ ক্রমশ মিলিয়ে গেল দূরে। কালো রাতের সাথে মিশে অদৃশ্য হয়ে গেল নেভিগেশন লাইট।
.
০৪.
গ্যালির পেছনে মাথাটা একদিকে কাত করল একজন অ্যাটেনড্যান্ট। ককপিটে কিসের আওয়াজ বলো তো? শুনতে পাচ্ছ?
হাতের কাজ ফেলে প্লেনের নাকের দিকে ঘুরল চিফ স্টুয়ার্ড, গ্যারি রুবিন। ভেঁতা, অবিচ্ছিন্ন গর্জনের মতো একটা আওয়াজ, যেন কাছে পিঠে কোথাও গেল হেল হোলের হ্যাঁচ, সেই সাথে থেমে গেল শব্দটাও।
কই, আর তো কিছু শুনতে পাচ্ছি না!
কিসের শব্দ ছিল ওটা?
কী জানি। আগে কখনও শুনিনি। একবার মনে হলো, প্রেশার লিক কিনা। অ্যাটেনড্যান্ট তার কাঁধ ছোঁয়া সোনালি চুল নেড়ে মেইন কেবিনের দিকে এগোল। তুমি বরং ক্যাপটেনকে জিজ্ঞেস করে জেনে নাও।
ইতস্তত করতে লাগল। জরুরি কোনো ব্যাপার না হলে ক্যাপটেন তাকে বিরক্ত করতে নিষেধ করেছেন। তবে, ভাবল সে, আগে তাকে প্লেন আর আরোহীদের নিরাপত্তার দিকটা দেখতে হবে। ইন্টারকম ফোনের রিসিভার কানে তুলল সে, চাপ দিল বোতামে। ক্যাপটেন, বলছি। মেইন কেবিনের সামনে থেকে অদ্ভুত একটা শব্দ শুনলাম আমরা। ওখানে কোনো সমস্যা দেখা দিয়েছে?
কোনো জবাব এল না। তিনবার চেষ্টা করার পরও সাড়া না পেয়ে দিশেহারা বোধ করল, বারো বছরের চাকরিতে এটা তার কাছে সম্পূর্ণ নতুন একটা অভিজ্ঞতা। কী করবে ভাবছে, এই সময় প্রায় ছুটতে ছুটতে ফিরে এল ফ্লাইট অ্যাটেনড্যান্ট, কী যেন বলল তাকে। প্রথমে কান দেয়নি তার কথায়, তারপর ঝট করে তার দিকে ঘুরল। কী বললে?