ওহে, মাইক গ্রাহাম, ড. গ্রোনকুইস্ট বললেন, লিলি কী পেয়েছে দেখো। মুদ্রাটা তার দিকে ছুঁড়ে দিলেন তিনি। আঁতকে উঠল লিলি। তবে, সময় মতো বই থেকে মুখ তুলে খপ করে সেটা ধরে ফেলল মাইক গ্রাহাম।
কয়েক মুহূর্ত পর মুখ তুলল সে। আমাকে বোকা বানানোর মতলব?
মন খুলে হাসলেন ড. গ্রোনকুইস্ট। তারপর বললেন, না হে। গ্রামের একটা ঘর থেকে সত্যি ওটা খুঁড়ে পেয়েছে লিলি।
ম্যাগনিফাইং গ্লাসটা বের করল মাইক গ্রাহাম। লেন্সের তলায় ফেলে মুদ্রাটা ভালোভাবে পরীক্ষা করল সে।
কী হলো? লিলি ধৈর্য রাখতে পারছে না। একটা কিছু রায় দাও।
অবিশ্বাস্য, বিড়বিড় করল মাইক, হতভম্ব দেখল তাকে। স্বর্ণমুদ্রা! প্রায় সাড়ে তেরো গ্রাম। আগে কখনও দেখিনি আমি। অত্যন্ত দুর্লভ। একজন কালেক্টর সম্ভবত দশ থেকে পনেরো হাজার ডলারে কিনতে চাইবে।
চেহারাটা কার সাথে মেলে বলতে পারো?
মেলে মানে! রোমান আর বাইজানটাইন সাম্রাজ্যের সম্রাট থিয়োডোসিয়াস দ্য গ্রেটের মূর্তি ওটা, দাঁড়িয়ে আছে। ঝাপসা হয়ে গেছে, কিন্তু ভালো করে তাকালে দেখতে পাবে সম্রাটের পায়ের কাছে বন্দিরা পড়ে আছে। লক্ষ করেছ সম্রাটের হাতে দুটো জিনিস-একটা গ্লোব আর একটা ব্যানার?
ব্যানার?
ব্যানারটায় পাশাপাশি দুটো গ্রিক অক্ষর রয়েছে, XP একটা মনোগ্রামের আকৃতিতে, যার অর্থ হলো-খ্রিস্টের নামে খ্রিস্ট ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার পর সম্রাট কনস্ট্যানটাইন মনোগ্রামটা গ্রহণ করেছিলেন, তারপর একে একে তার উত্তরাধিকারীরা এটা পেয়ে এসেছে।
উল্টোদিকের লেখাগুলো থেকে কী বুঝছ তুমি? প্রশ্ন করলেন ড. গ্রোনকুইস্ট।
আবার লেন্সে চোখ রাখল মাইক গ্রাহাম। তিনটে শব্দ। প্রথমটা মনে হচ্ছে… TRIVMFATOR বাকি দুটো পড়া যাচ্ছে না, মুছে প্রায় মসৃণ হয়ে গেছে। কালেক্টরস ক্যাটালগ থেকে বর্ণনা আর ল্যাটিন অনুবাদ পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু সভ্য জগতে ফেরার আগে খোঁজ করতে পারছি না।
সময়টা আন্দাজ করতে পারো?
চিন্তিতভাবে সিলিংয়ের দিকে তাকাল মাইক। থিয়োডোসিয়াসের শাসনকাল, যতদূর মনে হয়, তিনশো উনআশি থেকে তিনশো পঁচানব্বই খ্রিস্টাব্দ।
ঝট করে ড. গ্রোনকুইস্টের দিকে ফিরল লিলি। ঠিক বলেছে!
মাথা নাড়লেন তিনি। চতুর্থ শতাব্দীর এস্কিমোরা রোমান সাম্রাজ্যের সাথে যোগাযোগ করেছিল।
সম্ভাবনার কথা আমরা উড়িয়ে দিতে পারি না! জেদের সুরে বলল লিলি।
ব্যাপারটা জানাজানি হলে, দুনিয়াজুড়ে হৈচৈ পড়ে যাবে, বলল জোসেফ হসকিন্স, এই প্রথম মুদ্রাটা দেখছে সে।
ব্র্যান্ডির গ্লাসে ছোট্ট একটা চুমুক দিলেন ড. গ্রোনকুইস্ট। প্রাচীন মুদ্রা এর আগেও অদ্ভুত সব জায়গায় পাওয়া গেছে। কিন্তু মুদ্রার তারিখ বা কোথায় পাওয়া গেছে সে সম্পর্কে আর্কিওলজিস্ট মহলকে সন্তুষ্ট করতে পারে এমন প্রমাণ বিরল।
তা হয়তো সত্যি, মৃদুকণ্ঠে বলল মাইক। কিন্তু এটা এখানে কীভাবে এল জানার জন্য আমি আমার মার্সিডিজ কনভার্টিবলটা হারাতে রাজি আছি।
কিছুক্ষণ না বলে মুদ্রাটার দিকে তাকিয়ে থাকল ওরা, সবাই চিন্তিত। অবশেষে নিস্তব্ধতা ভাঙলেন ড. গ্রোনকুইস্ট, তার মানে একটা রহস্যের সামনে পড়েছি আমরা। শুধু এটুকুই জানি।
.
০৩.
মাঝরাতের খানিক পর প্লেন ত্যাগ করার প্রস্তুতি নিল ভুয়া পাইলট। স্বচ্ছ পরিষ্কার বাতাস, কালো মসৃণ সাগর তীরের ওপর স্নান একটা দাগের মতো মাথাচাড়া দিল আইসল্যান্ড। ছোট্ট দ্বীপদেশটার আকৃতি সবুজাভ সুমেরুপ্রভায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠল ধীরে ধীরে।
ছোটবেলা থেকেই রক্তদর্শনে অভ্যস্ত সে, লাশ দেখে তার চিত্তচাঞ্চল্য ঘটে না। ভাড়াটে খুনি হিসেবে অবিশ্বাস্য মোটা টাকা পায়, তার সাথে যোগ হয়েছে ধর্মীয় উন্মাদনা। কেউ তাকে অ্যাসাসিন বা আতঙ্কবাদী বললে ভয়ানক খেপে যায়। শব্দ দুটোর মধ্যে রাজনীতি গন্ধ আছে।
বহুরূপী বলতে যা বোঝায়, সে তা-ই। সমস্ত কলাকৌশল জানা আছে, দ্রুত চেহারা বদলানোয় তার জুড়ি মেলা ভার। নিখুঁত কাজ তার অন্যতম বৈশিষ্ট্য, একজন পারফেকমনিস্ট। ভিড় লক্ষ করে ব্রাশ ফায়ার করা বা গাড়িতে বোমা ফিট করা তার কাছে হাস্যকর বোকামি বলে মনে হয়। তার পদ্ধতি আরও অনেক সূক্ষ্ম। আন্তর্জাতিক তদন্তকারীরা তার অনেক কীর্তিকে অ্যাক্সিডেন্ট নয় বলে প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে।
কামিলকে খুন করাটা টাকার বিনিময়ে একটা কাজ বলে ভাবছে না সুলমান আজিজ। জাতিসংঘের মহাসচিবকে খুন করা তার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। আয়োজনবহুল প্ল্যানটা নিখুঁত করতে পাঁচ মাস সময় নিয়েছে সে। তার পরও ধৈর্য ধরতে হয়েছে সুবর্ণ সুযোগটির জন্য।
প্রায় অপচয়ই বলা যায়, মুচকি হেসে ভাবল সে। হে’লা কামিল রাজরানীর সৌন্দর্য নিয়ে অকালে মারা যাচ্ছে। মেয়েলোকটা বিরাট একটা হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
ধীরে ধীরে থ্রটল পিছিয়ে আনল সে। একটু একটু করে নিচে নামছে প্লেন। আরোহীরা কিছু টের পাবে না। তাছাড়া, কেবিনের আরোহীরা ইতোমধ্যে নিশ্চয়ই ঘুমে ঢুলছে। এইবার নিয়ে বারো বার হেডিং চেক করল সে। কম্পিউটর আগেই রিপ্রোগ্রাম দিয়ে রেখেছে, যেখানে সে নামতে চায় সেখানকার দূরত্ব আর সময়ের হিসাব সবই সঠিকভাবে পাচ্ছে। পনেরো মিনিট পর আইসল্যান্ডের দক্ষিণ উপকূলরেখা পেরিয়ে ভেতর দিকে চলে এল প্লেন। কাছাকাছি কোথাও কোনো লোকবসতি নেই। নিচের দৃশ্য বলতে ধূসর রঙের পাথর আর সাদা তুষার। স্পিড় কমাল সুলেমান আজিজ। ঘণ্টায় তিনশো বাহান্ন কিলোমিটার গতিতে ছুটছে প্লেন।