অত্যন্ত পুরনো মুদ্রা, কিনারাগুলো ক্ষয়ে গেছে। মুদ্রার গায়ে খুদে একটা গর্ত রয়েছে, চামড়ার একটা ফিতে ঝুলছে সেটা থেকে। কিছুর সাথে ঝুলিয়ে রাখা হতো ওটা, সম্ভবত ব্যক্তিগত অলঙ্কার হিসেবে কারও গলায়।
পাঁচ মিনিট পর, এখনও মুদ্রাটাকে পরীক্ষা করছে লিলি, রহস্যের কিনারা পাবার চেষ্টা করছে, এই সময় ঘরের দরজা খুলে গেল, ভেতরে ঢুকলেন বিশালদেহী সদয় চেহারার এক ভদ্রলোক, সাথে এক গাদা তুষার কণা নিয়ে। তার নিঃশ্বাসের সাথে বেরিয়ে আসছে সাদা বাস্প। দাড়ি আর ভ্রু তুষারে সাদা হয়ে আছে।
ড. হিরাম গ্রোনকুইস্ট হাসলেন। চারজনের আর্কিওলজিস্ট দলের প্রধান তিনি। বাধা দেয়ার জন্য দুঃখিত, লিলি, ভারী গলায়, মৃদু কণ্ঠে বললেন তিনি। তবে বড় বেশি খাটাখাটুনি করছো তুমি। একটু বিশ্রাম নাও। শেলটারে চলো, তোমাকে ব্র্যান্ডি খাওয়াব।
ডক্টর গ্রোনকুইস্ট, বলল লিলি, উত্তেজনা চেপে রাখার চেষ্টা করলেও গলা কেঁপে গেল তার। আপনাকে আমি অদ্ভুত একটা জিনিস দেখাতে চাই।
এগিয়ে এসে লিলির পাশে দাঁড়ালেন হিরাম গ্রোনকুইস্ট। কী পেয়েছো দেখি?
তাঁর সামনে মুঠোটা খুলল লিলি। দেখুন!
পারকার ভেতর থেকে হাতড়ে চশমাটা বের করে চোখে পরলেন ড. গ্রোনকুইস্ট। মুদ্রাটার ওপর ঝুঁকে পড়লেন তিনি, নাকটা প্রায় ঠেকে গেল সেটার গায়ে। চারদিক থেকে নেড়েচেড়ে পরীক্ষা করলেন তিনি মুদ্রাটা। তারপর মুখ তুলে লিলির দিকে তাকালেন, কৌতুকে নাচছে চোখের মণি দুটো। আমার সাথে ঠাট্টা করছে, তাই না?
জেদ নিয়ে তাকাল লিলি, তারপর পেশি ঢিল করে দিয়ে মুচকি হাসল। ওহ গড! আপনি ভাবছেন আমি নিজেই এটা এখানে রেখে আবিষ্কারের ভান করছি!
তোমাকেও স্বীকার করতে হবে, ব্যাপারটা পতিতালয়ে কুমারী খুঁজে পাবার মতো।
কিউট।
লিলির কাঁধে মৃদু চাপড় মারলেন ড. গ্রোনকুইস্ট। কংগ্রাচুলেশন্স। দুর্লভ একটা আবিষ্কার।
কিন্তু কীভাবে এটা এল এখানে?
হাজার মাইলের মধ্যে সোনার কোনো মজুদ নেই এদিকে। প্রাচীন লোক যারা, এখানে ছিল তারা খনি থেকে সোনা উদ্ধার করেছিল, তা সম্ভব নয়। পাথুরে যুগের চেয়ে সামান্য উন্নতি করেছিল তারা। মুদ্রাটা অবশ্যই আরও অনেক পরে অন্য কোনো। উৎস থেকে এখানে এসেছে।
কিন্তু যেসব শিল্পকর্ম আমরা উদ্ধার করেছি তার সবই তিনশো খ্রিস্টাব্দের, সেগুলোর সাথে এটা থাকে কীভাবে-এর কী ব্যাখ্যা দেবেন আপনি?
কাঁধ ঝাঁকালেন ড. গ্রোনকুইস্ট। নিজেকে আমার বোকা লাগছে।
ঠিক আছে, বোকার মতোই না হয় একটা কিছু আন্দাজ করুন।
বুদ্ধিতে যতটুকু কুলাচ্ছে-কোন ভাইকিং এটা বিনিময় করে বা হারিয়ে ফেলে।
পূর্ব তীরে ধরে এত দূর দক্ষিণে জলদস্যুদের কোনো জাহাজ এসেছিল, এমন কোনো রেকর্ড নেই।
আচ্ছা, এমন হতে পারে না যে আরও কাছাকাছি সময়ের এস্কিমোদের সাথে দক্ষিণের নর্স বসতি স্থাপনকারীদের বিনিময় বাণিজ্যে হয়েছিল? শিকারের সময় এই প্রাচীন গ্রামটা হয়তো ব্যবহার করা হয়।
আপনি খুব ভালো করেই জানেন, ড. গ্রোনকুইস্ট, চারশো খ্রিস্টাব্দের পর এদিকে লোকবসতির কোনো প্রমাণ আমরা পাইনি।
ভ্রু কুঁচকে লিলির দিকে তাকালেন ড. গ্রোনকুইস্ট। তুমি দেখছি হাল ছাড়ার পাত্রী নও। মুদ্রাটায় তো এমনকি কোনো তারিখও দেখছি না।
মাইক গ্রাহাম প্রাচীন মুদ্রা বিশেষজ্ঞ, চলুন দেখি সে কী বলে।
পারকার হুড অ্যাডজোস্ট করে নিয়ে কোলম্যান লণ্ঠনটা নিভিয়ে দিল লিলি। টর্চ জ্বাললেন ড. গ্রোনকুইস্ট, দরজা খুলে আগে বেরোতে দিলেন লিলিকে। অন্ধকারে কবরস্থানের ভূতের মতো গোঙাচ্ছে বাতাস। মুখের খোলা অংশে ঠাণ্ডা বাতাস যেন মৌমাছির হুল ফুটাল। একটা রশি ধরে এগোল ওরা, শেষ প্রান্তটা অ্যালুমিনিয়াম শেলটারে বাঁধা আছে। হাঁটতে ওপরে মুখ তুলল জেনিত। পরিষ্কার আকাশ, কালো ভেলভেটের মতো লাগল দেখতে, তারাগুলো নকশা এঁকে রেখেছে। তারার আলোয় পশ্চিমের পাহাড় পরিষ্কার চেনা গেল। খাড়িতে নেমে আসছে তুষার আর বরফ সেখান থেকে উপচে বেরিয়ে আসছে খোলা সাগরে। আর্কটিকের সৌন্দর্য সুন্দরী রমণীর হাতছানির মতো। পুরুষরা কেন যে ভালোবেসে ফেলে বুঝতে তার অসুবিধা হলো না।
টর্চের আলোয় ত্রিশ গজ হেঁটে নিরাপদ আশ্রয়ের স্টর্ম করিডরে পৌঁছল ওরা, আরও দশ ফুট পেরিয়ে দ্বিতীয় দরজা খুলে লিভিং কোয়ার্টারে চলে এল। বাইরের ঠাণ্ডার তুলনায় ভেতরটা উত্তপ্ত তন্দুর মনে হলো লিলির, কফির গন্ধ নাকে পারফিউমের পরশ বুলিয়ে দিল। পারকা খুলে নিজের কাপটা ভরে নিল সে।
স্যাম হসকিন্সের সোনালি চুল কাঁধ পর্যন্ত নেমে এসেছে, পাকানো রশির মতো গোঁফ, একটা ড্রাফটিং বোর্ডের ওপর ঝুঁকে রয়েছে। নিউ ইয়র্কের একজন আর্কিটেক্স, আর্কিওলজির প্রেমে অন্ধ। দুনিয়ার এমন কোনো সম্ভাব্য জায়গা নেই যেখানে খোঁড়াখুঁড়ির কাজে যেতে রাজি নয় হসকিন্স, নিজের পেশা ছেড়ে প্রতি বছরই দুমাসের জন্য এই কাজে গায়ের হয়ে যায় সে। সতেরোশো বছর আগে প্রাচীন গ্রামটা ঠিক কী রকম দেখতে ছিল, তার আঁকা নকশা থেকে সেটা জানতে পেরেছে ওরা।
মাইক গ্রাহাম দলের চার নম্বর সদস্য। নিজের ছোট্ট খাটে শুয়ে অতি ব্যবহারে মলিন একটা পেপার ব্যাক পড়ছে সে। অ্যাডভেঞ্চার গল্পের পাগল। তার হাতে বা পকেটে একটা বই নেই, এমন কখনও ঘটেছে কি না মনে করতে পারল না লিলি। যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম সেরা আর্কিওলজিস্টদের একজন সে। অল্প বয়সেই মাথায় মস্ত টাক দেখা দিয়েছে।