জেরি অসওয়ার্ল্ডকে কো-পাইলটের সিটে বসিয়ে স্ট্র্যাপ দিয়ে বাঁধতে ঘেমে গোসল হয়ে গেল সে। ফ্রাঙ্ক হার্টলির সেফটি বেল্ট বাঁধাই আছে, কাজেই তাকে আর ছুঁলো না। অবশেষে পাইলটের সিটে বসে প্লেনের পজিশন দেখল সে।
পঁয়তাল্লিশ মিনিট পর নির্ধারিত পথ থেকে প্লেনটাকে ঘুরিয়ে আরেক দিকে রওনা হলো ভুয়া পাইলট। নতুন পথটা সুমেরুর দিকে চলে গেছে।
.
০২.
দুনিয়ার সবচেয়ে বন্ধ্যা জায়গার একটা, এখানে কখনও ট্যুরিস্টদের আগমন ঘটেনি। গত কয়েকশো বছরে মুষ্টিমেয় কিছু এক্সপ্লোরার ও বিজ্ঞানী এই অভিশপ্ত এলাকায় মাঝেমধ্যে হাঁটাচলা করেছেন। উঁচু-নিচু তীর বরাবর সাগর দু এক সপ্তাহ বাদে বছরের বাকি সময় জমাট বেঁধে থাকে, শীতের শুরুতে তাপমাত্রা নেমে যায় ৭৩ ডিগ্রী ফারেনহাইটে। দীর্ঘ শীতের মাসগুলোয় ঠাণ্ডা আকাশটাকে গাঢ় অন্ধকার গ্রাস করে রাখে, এমনকি গরমের দিনেও চোখ ধাঁধানো রোদ এক ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে ভয়াবহ তুষার ঝড়ে অদৃশ্য হয়ে যায়।
জায়গাটা গ্রিনল্যান্ডের সর্ব উত্তরে। আরডেনক্যাপল ফিঅ্যারড-এর চারদিকে দাঁড়িয়ে আছে বরফ ঢাকা পাহাড়। বাতাস এখানে প্রতি মুহূর্তে ঝড়ের মতো বইছে। ভাবতে অবিশ্বাস্য লাগে যে প্রায় দুহাজার বছর আগেও এখনে একদল শিকারি বসবাস করত। ধ্বংসাবশে থেকে পাওয়া রেডিওকার্বন পরীক্ষা করে জানা গেছে দুশে থেকে চারশো খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত লোকবসতি ছিল এখানে। প্রত্নতাত্ত্বিক হিসেবে সময়টা তেমন লম্বা নয়, তবে তাদের রেখে যাওয়া গোটা বিশেক বাড়ি উৎসুক বিজ্ঞানীদের জন্য বিরাট কৌতূহল সৃষ্টি করেছে। হিমশীতল আবহাওয়ায় আজও প্রায় অক্ষত অবস্থায় রয়েছে বাড়িগুলো।
আগে থেকে তৈরি করা অ্যালুমিনিয়ামের কাঠামো হেলিকপ্টার থেকে রশি বেঁধে নামানো হয়েছে প্রাচীন গ্রামটার মাঝখানে, কাঠামোগুলো জোড়া লাগিয়ে নিজেদের জন্য নিরাপদ আস্তানা বানিয়ে নিয়েছে কলোরাডো ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানীরা। জবড়জং চেহারার হিটিং অ্যারেঞ্জমেন্ট আর ফোম-গ্লাস ইনসুলেশন রক্ত হিম করা ঠাণ্ডার সাথে অসম যুদ্ধে লিপ্ত। ঝোড়ো বাতাস বিরতিহীন গোঙালেও তাতে শুধু ভুতুড়ে হয়ে উঠেছে পরিবেশ, গ্রামের বাইরের পাঁচিল টপকে ভেতরে সহজে ঢুকতে পারে না। শীতের শুধুতে আর্কিওলজিকাল দলটিকে চারপাশে কাজ করার বিরাট একটা সুযোগ এনে দিয়েছে এই আশ্রয়।
লিলি শার্প, কলোরাডো ইউনিভার্সিটির একজন অধ্যাপিকা, অ্যানথ্রোপলজি পড়ায়। শীত বা তুষার ঝড় গ্রাহ্য করার মেয়ে নয় সে, দলের আর সবাই তাকে এস্কিমোদের বংশধর বলে ঠাট্টা করে। প্রাচীন শিকারিদের একটা ঘরের ভেতর মেঝের ওপর হাঁটুগেড়ে বসেছে সে, হাতে ছোট একটা তোয়ালে জড়িয়ে জমাট বাঁধা মাটি সতর্কতার সাথে আঁচড়াচ্ছে। ঘরের ভেতর সে একা, অতীত খুঁড়ে প্রাচীন যুগের নিদর্শন আবিষ্কারের কাজে মগ্ন।
লোকগুলো ছিল সি-ম্যামল শিকারি, শীতের সময়টা তারা নিজেদের ঘর-বাড়িতে কাটাত। ঘরগুলো আংশিক মাটির ভেতর গাঁথা, পাথরের তৈরি দেয়ালগুলো নিচু, ঘাস বা গাছের পাতা দিয়ে ছাওয়া ছাদ দাঁড়িয়ে আছে তিমির হাড় অবলম্বন করে। তেল দিয়ে কুপি জ্বেলে শরীর গরম রাখত তারা, দীর্ঘ অন্ধকার মাসগুলো ঘরের ভেতর অলস বসে না থেকে নদীর স্রোত থেকে তুলে নেয়া কাঠের টুকরো, হাতির দাঁত আর হরিণের শিং দিয়ে কুদে মূর্তি বানাত।
গ্রিনল্যান্ডের এই অংশে যিশুর জন্মের পর প্রথম শতাব্দীতে আস্তানা গেড়েছিল তারা। তারপর, তাদের সংস্কৃতির বিকাশ যখন তুঙ্গে, হঠাৎ করে পাততাড়ি গুটিয়ে বেমালুম অদৃশ্য হয়ে যায়। এর কোনো গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। তবে অদৃশ্য হলেও এখানে তারা নিজেদের বহু জিনিস ফেলে গেছে। ধ্বংসাবশেষ হিসেবে তা টিকে আছে আজও।
লিলির নিষ্ঠা আর শ্রম বৃথা গেল না। ডিনারের পর অ্যালুমিনিয়াম কাঠামোর ভেতর তার পুরুষ সঙ্গীরা বিশ্রাম নিচ্ছে, আবিষ্কারের আনন্দ থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত হলো তারা। ঝোড়ো বাতাস উপেক্ষা করে প্রাচীন গ্রামের ভেতর এসে কাজ করায় হরিণের শিংয়ের তৈরি একটা পাতিল পেয়ে গেল সে। হঠাৎ করে লিলির হাতের তোয়ালে কিসে যেন আটকে গিয়েই আবার মুক্ত হলো। একই জায়গায় ভোয়ালেটা আবার ঘষল সে, কান দুটো সজাগ। এবার একটা শব্দও শুনল। গর্তের ভেতর হাত গলিয়ে হাতড়াল, কিন্তু কিছুই পেল না। ভোয়ালে খুলে আঙুলের টোকা দিল মাটিতে। একটা আওয়াজ হলো। পাথরের আওয়াজ চেনা আছে, সে ধরনের নয়। আবার গর্তের ভেতরটা হাতড়াল সে। জিনিসটা একটু যে চ্যাপ্টা, তবে শব্দটা ধাতব। মাটির খানিকটা আবরণ সরাতেই এবার হাতে চলে এল।
সিধে হলো লিলি। ডানে বায়ে ঘুরে, আড়মোড়া ভাঙার ভঙ্গিতে, ঢিল করল পিঠের পেশি। কোলম্যান লণ্ঠনের আলোয়, উলেন ক্যাপের বাইরে, তার দীর্ঘ লাল চুল কোমল অগ্নিশিখার মতো জ্বলজ্বল করছে। মুঠোটা খুলল সে, নীল আর সুবজ মেশানো চোখে চিকচিক করে উঠল কৌতূহল। কয়লা-কালো মাটির প্রলেপ নিয়ে তালুতে পড়ে থাকা ছোট্ট জিনিসটা যেন তার বুদ্ধিমত্তাকে ব্যঙ্গ করল।
এখানে প্রাগৈতিহাসিক মানুষের নিজেকে মনে করিয়ে দিল লিলি শার্প। লোহা বা : তামার ব্যবহার তারা জানত না।
শান্ত থাকার চেষ্টা করলেও অবিশ্বাস আর বিস্ময়ের একটা জোয়ার গ্রাস করে ফেলল তাকে। তারপর এল উত্তেজনা, সবশেষে জরুরি তাগাদা। নখের হালকা আঁচড়ে মাটির আবরণ সরিয়ে ফেলল সে, লণ্ঠনের আলোয় চকচক করে উঠল জিনিসটা। হাঁ করে সেটার দিকে তাকিয়ে থাকল জেনি। আর কোনো সন্দেহ নেই। একটা স্বর্ণমুদ্রা আবিষ্কার করেছে সে।