সময় হলে আরোহীদের জানাব আমি, তা না হলে ভয় পাবেন ওঁরা।
ঘোষণায় এ কথাও জানিয়ে দিতে পারো যে জানালা দিয়ে কেউ যদি কোনো আলো দেখে, ধরে নিতে হবে ওগুলো আছে মাছ ধরার জাহাজ থেকে আসছে।
ঠিক আছে, স্যার।
চট করে একবার মেইন কেবিনের চারদিকে চোখ বুলিয়ে নিল লেমকে, চঞ্চল দৃষ্টি পলকের জন্য স্থির হলো হে’লা কামিলের ঘুমন্ত মুখের ওপর। তোমার মনে হয়নি, সিকিউরিটি অস্বাভাবিক কড়া? আলাপের সুরে জিজ্ঞেস করল সে। রিপোর্টারদের একজন আমাকে বলল, স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড নাকি সন্দেহ করছে মহাসচিবকে অপহরণ করা হতে পারে।
তাই নাকি?
ওদের ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে ধুলোর প্রতিটি কণায় সন্ত্রাসবাদীরা ওত পেতে আছে। আমার পরিচয়পত্র দেখে সন্তুষ্ট হয়নি, ব্যাগটাও সার্চ করল।
কাঁধ ঝাঁকাল চিফ স্টুয়ার্ড। খারাপটা কী। শুধু তো আরোহীদের নয়, আমাদের নিরাপত্তার প্রশ্নও জড়িত।
প্যাসেজের দুপাশে সিটে বসা আরোহীদের দিকে একটা হাত তুলল লেমকে। অন্তত ওদের কাউকে দেখে সন্ত্রাসবাদী বলে মনে হচ্ছে না।
চেহারা দেখে সবাইকে যদি চেনা যেত!
তা যা বলেছ। কাজেই একটু সাবধান হতে হয়। ককপিটের দরজা তালা দিয়ে রাখছি, বুঝলে। খুব যদি জরুরি কিছু বলতে চাও, ইন্টারকমে ডেকো আমাকে।
ঠিক আছে, স্যার।
কফিতে মাত্র একটা চুমুক দিয়ে কাপটা নামিয়ে রাখল লেমকে, ফিরে এল ককপিটে। ফার্স্ট অফিসার, তার কো-পাইলট, পাশের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ওয়েলস-এর আরো দেখছে, তার পেছনে কম্পিউটারের সাহায্যে ফুয়েলের খরচ ও মজুদ জেনে নিচ্ছে প্রকৌশলী।
তাদের দিকে পেছন ফিরে কোটের বুক পকেট থেকে ছোট একটা চামড়ার বাক্স বের করল লেমকে। বাক্স খুলে হাতে একটা সিরিঞ্জ নিল, নার্ভ এজেন্ট সারিন ভরল তাতে। ক্রুদের দিকে ফিরল আবার, হাঁটতে শুরু করে হোঁচট খেল, যেন ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে, সামলে নেয়ার জন্য খপ করে সেকেন্ড অফিসারের বাহু আঁকড়ে ধরল। দুঃখিত, ফ্রাঙ্ক, কার্পেটে পা বেধে গিয়েছিল।
ফ্রাঙ্ক হার্টলির গোঁফ জোড়া ঘন আর কালো, মাথায় কাঁচা-পাকা চুল, সুদর্শন চেহারা। সূচটা এতই সরু আর তীক্ষ্ণমুখ যে টেরই পেল না তার কাঁধে কিছু ঢুকছে। ইঞ্জিনিয়ারের প্যানেলে সাজানো এক গাদা আলো থেকে চোখ তুলে হাসল সে। বয়স হয়েছে, এবার কিন্তু আপনার মদ খাওয়া কমিয়ে দেয়া উচিত, ক্যাপটেন।
প্লেন তো সোজাই চালাই, হালকা সুরে বলল লেমকে। শুধু হাঁটার সময় তাল পাই না।
মুখ খুলল ফ্রাঙ্ক হার্টলি, যেন কিছু বলতে চায়, কিন্তু হঠাৎ করে ভাবলেশহীন হয়ে পড়ল তার চেহারা। মাথা ঝাঁকাল সে যেন দৃষ্টি পরিষ্কার করতে চাইছে। পরমুহূর্তে উল্টে গেল চোখ জোড়া, স্থির হয়ে গেল শরীর।
হার্টলির গায়ে হেলান দিয়ে থাকল লেমকে, সিট থেকে সে যাতে কাত হয়ে না পড়ে। সিরিঞ্জটা খুলে নিয়ে ব্যাগে ভরল, বের করল নতুন আরেকটা, দ্বিতীয়টাতে আগেই সারিন ভরে রেখেছে। আরে, ফ্রাঙ্কের কিছু হলো নাকি? অমন নেতিয়ে পড়ল কেন!
কো-পাইলটের সিটে ঝট করে ঘুরল প্রকাণ্ডদেহী ফাস্ট অফিসার জেরি অসওয়ার্ল্ড, চোখে প্রশ্ন। সে কি!
এসে দেখো না একবার।
সিট ছেড়ে উঠে এল জেরি অসওয়ার্ল্ড, ক্যাপটেনকে পাশ কাটিয়ে ঝুঁকে পড়ল সেকেন্ড অফিসারের দিকে। সূচ ঢুকিয়ে সিরিঞ্জের মাথায় চাপ দিল লেমকে, তবে জেরি অসওয়ার্ল্ড ব্যথাটা অনুভব করল।
উফ! কী ব্যাপার! ঝট করে ঘুরতেই ক্যাপটেনের হাতে সিরিঞ্জটা দেখতে পেল সে। ফ্রাঙ্ক হার্টলির চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী জেরি অসওয়ার্ল্ড, বিষটা সাথে সাথে কাজ শুরু করেনি। নগ্ন সত্য প্রকাশ পাবার সাথে সাথে তার চোখ বিস্ফারিত হয়ে উঠল, পরমুহূর্তে দুহাত সামনে বাড়িয়ে ক্যাপটেনকে লক্ষ্য করে ঝাঁপিয়ে পড়ল সে। কে তুমি? গলাটা দুহাতে ধরে ফেলে গর্জে উঠল। ডেইল লেমকে কোথায়? তার ছদ্মবেশ নিয়ে…
ইচ্ছে থাক বা না থাক, উত্তর দেয়ার উপায় নেই ছদ্মবেশী লোকটার, কারণ জেরি অসওয়ার্ল্ডের বিশাল দুটো হাত তার গলায় এমনভাবে চেপে বসেছে যে দম ফেলতে পারছে না সে। একটা বাল্কহেডের সাথে তাকে চেপে ধরল জেরি অসওয়ার্ল্ড। মারা যাচ্ছে বুঝতে পেরে মরিয়া হয়ে উঠল ছদ্মবেশী পাইলট। ভাঁজ করা হাঁটু দিয়ে জেরি অসওয়ার্ল্ডের তলপেটে প্রচণ্ড গুতো মারল সে। সামান্যই প্রতিক্রিয়া হলো, একবার শুধু গুঙিয়ে উঠল জেরি অসওয়ার্ল্ড। চোখে অন্ধকার দেখছে নকল পাইলট।
তারপর, ধীরে ধীরে, গলার ওপর থেকে কমে এল চাপটা, হোঁচট খেতে খেতে পিছিয়ে গেল জেরি অসওয়ার্ল্ড। মৃত্যু উপস্থিত বুঝতে পেরে আতঙ্কে বিকৃত হয়ে উঠেছে। তার চেহারা। চোখে দিশেহারা ভাব আর ঘৃণা নিয়ে পাইলটের দিকে তাকিয়ে আছে সে। শরীরের সমস্ত শক্তি এক করে শেষ একটা ঘুষি মাল পাইলটের পেটে।
হাঁটু ভাঁজ হয়ে গেল লেমকের, কুঁজো হয়ে গোঙাতে লাগল। সিধে হতে শুরু করে দেখল সামনেটা ঝাপসা লাগছে। পাইলটের সিটে ধাক্কা খেয়ে কার্পেটের ওপর পড়ে গেল জেরি অসওয়ার্ল্ড, আর নড়ল না। কয়েক সেকেন্ড ককপিটের মেঝেতে বসে থাকল লেমকে, সশব্দে হাঁপাচ্ছে, ব্যথা কমাবার ব্যর্থ চেষ্টা করছে পেটে হাত বুলিয়ে।
খানিক পর আড়ষ্ট ভঙ্গিতে দাঁড়াল সে। দরজা, ওদিক থেকে নানা ধরনের শব্দ ভেসে আসছে। মেইন কেবিনে কোনো হৈচৈ নেই বলে মনে হলো তার। ইঞ্জিনের শব্দকে ছাপিয়ে ককপিটের কোনো আওয়াজ দরজার ওদিকে পৌঁছায়নি।