আপনি এর মধ্যে এসে পড়লেন কিভাবে?
MOB বাহিনীর দায়টা আমারই। মানে, আমাদের সার্ভিসের। আমাদের কাছে কাগজপত্র সব এসে গেল। ফাইলটা আমার নজরে পড়ে। হাতে সময় ছিল। আসলে লোকটাকে খুঁজে বার করবার কাজটা যেচেই ঘাড়ে নিলাম।
কেন?
ভাগ্যচক্রে ওবাহসার ছিলেন আমার আত্মীয়ের মত। যুদ্ধের আগে ওর কাছে স্কীর তালিম নিয়েছিলাম। এমন একটা সময় গেছে যখন ওঁকে পেলেই বাবার অভাব পূরণ হয়ে গিয়েছিল। মুখ ফেরালেন মেজর স্মিথ। আমি দুঃখিত।
বন্ড উঠে দাঁড়াল। আচ্ছা এবার আমাকে কিংসটনে ফিরতে হবে। হঠাৎ করে বিরস কণ্ঠে বলে উঠল, আপনাকে নিয়ে যাবার জন্য তোক পাঠাতে সপ্তাহ খানেক লেগে যাবে। বাগান পেরিয়ে, বাড়ির মধ্যে গিয়ে বেরিয়ে গেল বন্ড।
পানির নিচে প্রবাল প্রাচীরের পাশাপাশি শিকার খুঁজতে খুঁজতে মেজর স্মিথ বন্ড ছোকরার শেষ কথাগুলোর গূঢ় অর্থটা বোঝার চেষ্টা করছিলেন। তিনি ভাবতে লাগলেন, এ তো জানা কথা, অবধারিত। একজন অপরাধী অফিসারকে কাঠগড়ায় না তুলে তার হাতে একটা রিভলভার ধরিয়ে দিয়ে একা ফেলে রেখে যাওয়ার মতন আর কি; বন্ড ইচ্ছা করলে জ্যামাইকা রেজিমেন্ট-এর কোনও অফিসারকে দিয়ে গ্রেফতার করতে কি পারত না? না করে ভালই করেছে।
আত্মহত্যায় ঝঞ্ঝাট কম, গাদা গুচ্ছের ফাইল তৈরি করতে হয় না। বন্ডকে কৃতার্থ করবার জন্য সত্যিই নির্ঝঞ্ঝাট হতে চেষ্টা করবেন নাকি মেজর স্মিথ? নাকি যাবজ্জীবন কারাবাসের অসহনীয় যন্ত্রণা এবং তারই অনিবার্য পরিণামে তৃতীয় বারের হার্ট অ্যাটাক কিংবা আত্মপক্ষ সমর্থন করবেন? নাটকীয়ভাবে আদালতের কাছে ক্ষমাভিক্ষা করবেন?
তিনি ভাবতে লাগলেন যে, তিনি যে মহিমাময় ভঙ্গিতে কাঠগোড়ায় দাঁড়িয়ে আছেন, সামরিক আদালতের জন্য নির্দিষ্ট বিশেষ ধরনের নীল আর লাল আনুষ্ঠানিক ইউনিফর্মের ওপর মেডেলগুলো ঝলমল করছে। তিনি দেখলেন– তার পক্ষ সমর্থন করতে নিচে, আদালতের মেঝেয় দাঁড়িয়ে রয়েছে একটি স্থির গম্ভীর মূর্তি, মেজর স্মিথের পদমর্যাদার খাতিরে অন্তত কর্নেল ধাপের কেউ হবে নিশ্চয়ই। তাছাড়া হাইকোর্টে আপিল করবার রাস্তা তো খোলাই রইল… তিনি বেশ উত্তেজিত হয়ে উঠলেন।
পানির নিচে মেজর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলেন। তিনি ঠিক করলেন দিবা নিদ্রার পর বেশ ভাল করে সবটা ভেবে দেখবেন। দৈনন্দিন জীবনের পরিচিত ঘটনার আশ্বাসে মনটা চাঙ্গা হয়ে উঠল, বন্ডের ছবিটা চোখের সামনে থেকে ঝাপসা হয়ে গেল।
হঠাৎ তার স্কৰ্প-ওয়ার এর কথা মনে পড়তে মেজর প্রবাল স্তূপের অলিগলি দিয়ে পানি কেটে কেটে সামনের দিক এগিয়ে যেতে লাগলেন, মনটা আবার তার একাগ্র হয়ে উঠল। কিছুক্ষণের মধ্যে গলদা চিংড়ির উঁড় দুটো চোখে পড়ল–কালো পাথরের খোদল থেকে বাইরে বের করে নাড়ছে, মেজর স্মিথের অঙ্গ সঞ্চালনে পানি নড়ে ওঠায়। কৌতূহল সামলাতে পারছে না। কিন্তু আজ অন্য কোন শিকার নয়, একটিমাত্র প্রাণী ছাড়া আর কোনও কিছুর দিকে মন দেওয়া নয়–কেবল কদাকার, বেটপ একটা স্কর্পিয়ন ফিসের দেখা পেতে হবে। দশ মিনিট পরে সাদা বালির ওপর একটি বস্তু চোখে পড়ল। স্মিথ উঠে দাঁড়ালেন। ঐ পিণ্ডকার বস্তুটির পিঠের ওপর বিষের কাঁটাগুলো খাড়া হয়ে ওঠার জন্য অপেক্ষা করে রইলেন। বেশ বড়, পৌনে এক পাউন্ড হবে। কটমটে লাল চোখ দুটো এবার ড্যাবড্যাব করছে, তাকে লক্ষ্য করছে। যতটা পারা যায় ওপর দিকে থেকে এক ঘায়ে গাততে হবে ওটাকে, না হলে, তার অভিজ্ঞতায় বলে, ব্যাটার পাথুরে মাথার দু পাশ থেকে সঙ্গে সঙ্গে ছুঁচের মত সরু সরু কাঁটাগুলো দাঁড়াগুলো স করে বেরিয়ে আসবে। তিনি খুব সাবধানে বাঁ হাতটা পাখনার মত নেড়ে নেড়ে সাঁতরে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলেন। সুযোগ বুঝে নিচের দিকে তাক করে সজোরে কোচের ঘা বসালেন। কিন্তু সামান্য আন্দোলনটুকুও টের পেয়ে গেছে। মাছটা। সে বালি ছেড়ে উঠে মেজর স্মিথের পেটের তলা দিয়ে বেরিয়ে গেল। মাছটা একটা শ্যাওলা ঢাকা পাথর নাগালে পেয়ে তারই আড়ালে আশ্রয় নিল। মেজর আর একবার সুযোগ বুঝে আগের চেয়ে নিখুঁত তাক করে কোঁচটাকে সজোরে বসিয়ে দিলেন মাছটার দেহে। কোচের ডগায় ঝটপট করতে করতে মুচড়ে মুচড়ে উঠতে লাগল তার বাঞ্ছিত শিকার।
উত্তেজনায় হাঁপাতে লাগলেন মেজর। মাটিতে পা রেখে দাঁড়িয়ে মাছটাকে এফোঁড়-ওফোঁড় করে বিধলেন। তারপর? কোচের ডগাটা পানির ওপর বাড়িয়ে ধরলেন। তারপর তিনি অগভীর শান্ত পানির এলাকাটা পেরিয়ে এসে পানি ছেড়ে বাড়ির সামনের ঢালু বেলাভূমিতে এসে উঠেলেন। কেঁচসমেত মাছটাকে ঘাসের উপর ছুঁড়ে ফেলে বেঞ্চিতে বসলেন। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেওয়ার পর তার তলপেটের কাছাকাছি একটা অদ্ভুত অনুভূতিহীন অসাড়তা অনুভব করলেন স্মিথ। নিতান্ত স্বাভাবিক চেতনার বশেই ঘাড় হেঁট করে তাকালেন একবার, আর সঙ্গে সঙ্গে সারা শরীরটা আতঙ্কে শিউরে উঠল। পেটের কাছে খানিকটা চামড়া তাঁর তামাটে রঙের অস্বাভাবিক সাদা দেখাচ্ছে, আর সেই সাদা জায়গাটার মাঝখানে তিনটে লম্বালম্বি আঁচড়ের দাগ, প্রত্যেকটা দাগের গায়ে রক্তের ছোট ছোট ফোঁটার সারি। গর্তগুলো ছুঁচ। ফোঁটানোর মত সূক্ষ্ম, কিন্তু স্কর্পিয়ন ফিশ-এর সেই বালি ছেড়ে উঠে পেটের তলা দিয়ে গলে পালানোর ছবিটা স্পষ্ট ভেসে উঠল মেজর স্মিথের মনের পর্দায়। তার মনে আতঙ্ক আর বিস্ময়, কিন্তু আক্রোশ নেই। পাথরের মত নিশ্চল হয়ে বসে রইলেন। তিনি একটি আমেরিকান বই হাতে পেয়েছিলেন। মারাত্মক সামুদ্রিক প্রাণী –তাতে স্কর্পিয়ন ফিশের কাঁটার খোঁচা সম্বন্ধে যা লেখা আছে, বসে বসে সেই কথাগুলো মনে করতে লাগলেন। আলতো করে আঙুল বুলিয়ে দেখলেন ক্ষতস্থানের চারিপাশে। চামড়ায় কোন সাড়া নেই, ভেতরে চিনচিন করে যন্ত্রণা শুরু হয়ে গেছে। আস্তে আস্তে যন্ত্রণাটা তীক্ষ্ণ হয়ে উঠবে। তারপর সারা দেহে ছড়িয়ে পড়তে থাকবে; জ্বালার চোটে আছাড় খেতে হবে। তারপর সারা শরীরে খিচুনি শুরু হবে, ভুল বকতে শুরু করবেন, অজ্ঞান হয়ে যাবেন। হৃৎপিণ্ড আর কাজ করবে না। প্রাণস্পন্দন থেমে যাবে। বইটায় যা লেখা আছে সমস্ত ব্যাপারটা মাত্র মিনিট পনেরর মধ্যে ঘটে যাবে। এর চিকিৎসা যে নেই তা নয়–প্রোকেন, অ্যান্টিবায়োটিক, অ্যান্টি-হিস্টামিন–তবে দুর্বল হৃদপিণ্ডের সইতে পারলে হয়।