শেষ পর্যন্ত কি করে যে তিনি জীপে এসে পৌঁছেছিলেন তা আজো হেঁয়ালি হয়ে রয়েছে তার কাছে। বারবার ভারি বাট দুটো পায়ের গোছে এসে পড়ে, বারবার দু হাতে মাথা রেখে বসে পড়তে হয়। এভাবে যখন জীপের কাছে এসে পৌঁছালেন তখন আর তিনি দাঁড়িয়ে থাকতে পারলেন না, এলিয়ে পড়লেন।
কিন্তু এখনো তার অনেক কাজ বাকি। জঙ্গলের মধ্যে বেশ বড়-সড় পাথরের ভীড়ে এমন একটা জায়গায় আসল মালটা পুতে রাখতে হবে যেটা পরে চিনতে পারা যায়। তারপর এমন কোন ঘুরপথে হোটেলের আস্তানায় ফিরে যেতে হবে যাতে ওবাহসার-এর বাড়ির ত্রিসীমানায় না যেতে হয়।
আস্তানায় ফিরে খাওয়া-দাওয়া সেরে শুয়ে পড়লেন। পরের দিন MOB A বাহিনী বেরিয়ে পড়ল মিটারসিল উপত্যকার দিকে নতুন সূত্রের হদিশ পেয়ে। আর তারও ছ মাস পরে মেজর স্মিথ ফিরে এলেন লন্ডনে। তখন যুদ্ধ। শেষ হয়ে গেছে।
মেজরের লড়াই শেষ হলেও সমস্যা শেষ হয়নি। সোনা চোরাচালান করা সহজ নয়। বিশেষ করে মেজর স্মিথকে যে পরিমাণ পাচার করতে হবে তা প্রায় অসম্ভব। এবার বাট দুটোকে যেভাবে হোক লুকিয়ে রাখতে হবে। তিনি অস্থায়ী যে সামরিক পদমর্যাদা ভোগ করেছিলেন সেটা ছাড়লেন না। বিশেষ করে সামরিক গোয়েন্দা বিভাগের ছাড়পত্রের সুবিধাটুকু তো নয়ই এবং কিছুদিনের মধ্যেই ভেতরে ভেতরে তদ্ধির করে মিউনিখের কম্বাইন্ড ইন্টারোগেশন সেন্টার এর ব্রিটিশ প্রতিনিধি হিসাবে কাজ নিয়ে ফের জার্মানাতি যাবার ব্যবস্থা করে ফেললেন। সেখানে, মাস ছয়েকের মধ্যে। খুচরো কাজকর্মের অবকাশে সোনার বাট দুটো তুলে এনে নিজের কোয়ার্টারে স্যুটকেসের মধ্যে ভরে রাখলেন। তারপর সাপ্তাহিক ছুটিতে উড়োজাহাজে বার দুয়েক ইংল্যান্ডে গেলেন যখন, তখন একটা-একটা করে দুটো বাটই। পাচার করলেন ভারি ব্রীফকেসে ভরে। তার জন্য দরকার হয়েছিল লোহার মত শক্ত মন আর দুটো বেজেড্রিন ট্যাবলেট।
শেষ পর্যন্ত কিংসটনে এক বুড়ির ফ্ল্যাটের একেবারে নিচের ঘরে তার সম্পত্তিটির জন্য নিরাপদ একটা জায়গা খুঁজে পেলেন।
রয়্যাল মেরিনস্-এর কাজে ইস্তফা দিলেন। তারপর MOB হেড কোয়ার্টারের যে সব মেয়ের সঙ্গে আগে রাত কাটাতেন, তাদের একজনকে বিয়ে করলেন। মধ্যবিত্ত বনেদি পরিবারের মেয়ে। আভনমাউথ থেকে জ্যামাইকার কিংস্টন-এ যে বোট যায়, তারই একটায় মেজর দুজনের টিকিট কাটলেন।
ভাল ভাল খাবার, সস্তার মদের স্বর্গরাজ্য হল জ্যামাইকা। বিধিনিষেধের আড়ষ্টতা আর শ্রমিক সরকারের কড়াকড়ির হাত থেকে উদ্ধার করে নিশ্চিন্ত আশ্রয় দেবে জ্যামাইকা! এ ব্যাপারে দুজনেই একমত।
ইংল্যান্ড ছেড়ে যাবার আগে মেজর সোনার বাট দুটো মেরিকে দেখিয়েছিলেন। বললেন, ভেবেচিন্তেই কাজ করেছি। সমস্ত সম্পত্তি বেচে দিয়ে সোনার বাট করে নিয়েছি। ন্যায্য দামে যদি বেচে দেওয়া যায় তবে বিশ হাজার পাউন্ডের কিছু বেশি হবে। মাঝে মাঝে খানিকটা করে কেটে নিয়ে যদি বেচে দিই তবে বেশ সুখে-স্বাচ্ছন্দেই জীবনটা কাটিয়ে দেওয়া যাবে।
মেরি পার্নেল মুদ্রা-সংক্রান্ত আইন-কানুনের ব্যাপারে কিছুই বোঝেন না। তাই ঝকঝকে বাট দুটোর ওপর সস্নেহে হাত বুলিয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে স্মিথের গলা জড়িয়ে ধরে একটা চুমু খেয়ে নিলেন। মেজর বললেন, এখন আমরা সত্যিই বড়লোক তবে আমাকে কথা দিতে হবে যে, একথা কোনদিন তুমি কারোর কাছে ফাস করবে না। তাহলে জ্যামাইকার সব কটা ডাকাত একেবারে ছেকে ধরবে আমাদের।
মেরি পার্নেল বললেন যে, কথা দিলাম।
কিংসটনের একটু ওপরে নিচু পাহাড়ের কোলে প্রিন্সেস ক্লাব, সত্যিই নন্দনকানন। ঢালাও খানা, সুলভ পানীয়, আর সেই সঙ্গে নিরক্ষীয় উষ্ণমণ্ডলের বিস্ময়কর প্রাকৃতিক শোভা, যা দুজনের কেউই আগে কখনো দেখার সুযোগ পাননি। মেজর স্মিথের সামরিক কৃতিত্বের দৌলতে গভর্নমেন্ট হাউস-এর সরকারি মহলেও আনাগোনার সুযোগ। পেলেন। এরপর থেকে দিনগুলো তাদের সুখেই কাটতে লাগল। সন্ধ্যায় মেরির জন্য ব্রীজ আর মেজরের জন্য বাজি ধরা পোকার, মেরির জন্য টেনিস আর মেজর স্মিথের জন্য গল। দুজনের যা পুঁজি ছিল যুদ্ধকালীন বাড়তি পারিতোষিকের দৌলতে তা কেঁপে উঠেছিল খানিকটা। তারপর একটা বছর শুলুক সন্ধান নিতে শেষ পর্যন্ত আমদানি রপ্তানি ব্যবসায়ী মেসার্স ফু-র সঙ্গে কারবার চালাবেন বলে ঠিক করলেন মেজর।
প্রচণ্ড ধনী ফু-দের দুই ভাই। জ্যামাইকার চৈনিক সম্প্রদায়ের একচ্ছত্র নেতা। অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে যে সমস্ত তথ্য জোগাড় করা গেছে তাতে একটা ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হওয়া গেছে যে, ওদের বিশ্বাস করা যায়। সারা পৃথিবীতে সোনার সরকারি দাম ধার্য করে ব্রেটন উডস কনভেশন-এ চুক্তি সই হয়ে গেছে তখন। দুটি করমুক্ত বন্দর, ট্যাঞ্জিয়া আর মরক্কো। বিভিন্ন কারণে ব্রেটন উড়ন্স কনভেশন-এর আওতায় পড়েনি। ইতিমধ্যে সবাই জেনে গেছে যে, এই দুই জায়গায় বিশ্ববাজারের তুলনায় সোনার দাম অনেক বেশি পাওয়া যায় বাঁধা দাম যেখানে আউন্স প্রতি পঁয়ত্রিশ ডলার, ট্যাঞ্জিয়ায় বা মরক্কোতে সেখানে অন্তত একশ ডলার। প্রতিবেশী ম্যাকও-তে সোনার চোরাচালানের ঘাঁটি হয়ে উঠেছে হংকং। তাই মওকা বুঝে ফু-রাও নতুন করে হংকং-এর সঙ্গে লেনদেন শুরু করে দিয়েছে। ফু-ভাইদের সঙ্গে কথাবার্তা বেশ ভালই হল। কিন্তু পরীক্ষা করে দেখার সময়ে বাটের ওপর ছাপ নেই দেখে জানতে চাওয়া হল, সোনাটা আসলে কোন্ দেশের। টেবিলের ওপাশ থেকে বড় ভাইয়ের অমায়িক প্রশ্ন শোনা গেল, দেখুন, মেজর, সোনার বাজারে যে-কোনও সম্ভ্রান্ত দেশের জাতীয় ব্যাংক বা নামী কারবারিদের ছাপের খুব কদর। যাচাই করে দেখার কোন্ দরকারই হয় না। ছাপ থাকা মানেই জিনিসটা খাঁটি। অবশ্য এমন অনেক ব্যাংক বা কারবারি আছে, নিখাদ সোনা তৈরি করার কায়দাটা যাদের নিখুঁত হয়। এই চমৎকার বাট দুটো কোন দেশের তা যদি নেহাৎই ভুলে গিয়ে থাকেন, তাহলে, আমরা একটু যাচাই করে দেখে নিলে নিশ্চয়ই আপত্তি নেই। এসব সোনার বাট ঠিক কতটুকু খাঁটি তা যাচাই করার নানান রকম রাস্তা আছে। এসব কাজ আমাদের দু ভাইয়ের বেশ রপ্ত আছে। এগুলো আপাতত আমাদের কাছে জমা রেখে লাঞ্চের পরে যদি আসেন?