বন্ড ড্রাক্সের পেছন পেছন গেল। ইস্পাতের দেওয়ালের গায়ে আটকানো একটা হাতল তিনি ঘোরালেন। হুশ করে একটা দরজা খুলে গেল। তিন ফুট দূরে আরও একটা ইস্পাতের দরজা। বন্ড লক্ষ্য করল দুটো দরজার কিনারাই রবার দিয়ে মোড়া। বাতাস যাতায়াত বন্ধ। বাইরের দরজাটা বন্ধ করার আগে দোড়গোড়ায় দাঁড়িয়ে ইস্পাতের গোলাকার দেওয়ালের ওপরকার আরও কতকগুলো চ্যাপ্টা হাতল দেখিয়ে ড্রাক্স বললেন, নানান কারখানার দরজা। ইলেকট্রিশিয়ানুস জেনারেটার, ফুয়েলিং কন্ট্রোল, ওয়াশরুম, স্টোর, পাশের দরজাটা খোলার আগে বাইরের দরজাটা তিনি বন্ধ করলেন। তারপর নিজের অফিস ঘরে এসে বন্ধ করলেন দ্বিতীয় দরজাটা।
ঘরটা অনাড়ম্বর। রঙ ফ্যাকাশে ধূসর। বড় একটা ডেস্ক, ইস্পাতের টিউব আর গাঢ় নীল ক্যাম্বিস কাপড়ের কয়েকটা চেয়ার। মেঝেয় ছাই রঙা কারপেট। দুটো সবুজ ফাইলিট ক্যাবিনেট। একটা প্রকাণ্ড রেডিও-সেট। আধ খোলা একটা দরজা দিয়ে টালির মেঝের বাথরুমের খানিকটা চোখে পড়ে। ডেস্কের সামনে প্রকাণ্ড ফাঁকা একটা দেয়াল। মনে হয়। অস্বচ্ছ কাঁচ দিয়ে তৈরি।
দেয়ালটার কাছে গিয়ে ডানদিকের স্যুইচ তিনি টিপলেন। পুরো দেয়ালটা আলোকিত হয়ে উঠল। বন্ড দেখতে পেল দুটো ম্যাপলম্বায় আর চওড়ায় প্রায় ছ-ফুট। কাঁচটার পেছনে সেগুলো আঁকা। বাঁ দিকের ম্যাপ ইংলন্ডের পূর্বাঞ্চলের, পোর্টসমাউথ থেকে হাল্ আর সংলগ্ন সমুদ্রের ল্যাটিচিউড ৫০ থেকে ৫৫। ডোভারের কাছে লাল একটা ফুটকি। মুনরেকারের সেইখানে অবস্থিতি। সেই ফুটকি থেকে নানা বৃত্তের বক্ররেখা দিয়ে ম্যাপের উপর দশ মাইল অন্তর দুরত্ব আঁকা। ফ্রিজিয়ান দ্বীপপুঞ্জ থেকে হাল এর মাঝখানে, মুনরেকারের অবস্থান থেকে আশি মাইল দূরে সমুদ্রের মাঝখানে হীরের আকারের লার একটা চিহ্ন।
ম্যাপটার ডানপাশে নানা গাণিতিক চিহ্ন আর কম্পাসের হিসেব। ড্রাক্স সেগুলো দেখিয়ে বললেন, বাতাসের গতিবেগ, আবহাওয়ার চাপ–উইরোগুলোর জন্য নানা হিসেবের ফর্দ। রকেটের গতি আর পাল্লা স্থির ধরে নিয়ে ঐ সব হিসেব পত্র করা হয়েছে। এবার মিনিস্ট্রি আর বিমান বাহিনীর জেট প্লেন থেকে দৈনিক আমরা আবহাওয়ার খবর পাই। জেটপ্লেনগুলো যথাসম্ভব উপরে উঠে হিলিয়াম গ্যাস ভরা বেলুন ছাড়ে। সেগুলো আরও উপরে উঠতে পারে। পৃথিবীর আবহাওয়া প্রায় পঞ্চাশ মাইল উপর পর্যন্ত বিস্তৃত। কুড়ি মাইল উপরে বায়ুস্তর খুবই হালকা। মুনরেকারকে বাধা দিতে পারবে না। প্রায় বায়ুশূন্য আকাশের মধ্যে দিয়ে মুনরেকা ছুটবে। প্রথম কুড়ি মাইল ওঠাই সমস্যা। আর একটা সমস্যা হচ্ছে মাধ্যাকর্ষণ। তুমি জানতে চাইলে ওসব ব্যাপার ওয়ালটার তোমাকে বুঝিয়ে দেবে। শুক্রবার শেষ কয়েক ঘণ্টা ঘরে ক্রমাগত আবহাওয়ার খবর আসবে। ছোঁড়ার ঠিক আগে জাইরোগুলো আমরা সেট করব। এখন প্রতি সকালে মিস ব্র্যান্ড সমস্ত খবরগুলো জড় করে জাইরোসেটিং-এর জন্য একটা ছক তৈরি করে।
দ্বিতীয় ম্যাপটা ড্রাক্স দেখালেন। সেটা রকেটের ছোড়বার জায়গা থেকে লক্ষ্যবস্তু পর্যন্ত উপবৃত্তীয় যাত্রাপথ। সেখানে আরও অনেক সংখ্যা ছড়ানো। ড্রাক্স বললেন, রকেটের বক্র গতিপথের উপর পৃথিবীর গতি প্রভাব আছে। রকেট যখন উড়বে পৃথিবী তখন ঘুরবে পূর্বদিকে। সে হিসেবটা মেলাতে হবে অন্য ম্যাপের সংখ্যাগুলোর সঙ্গে। ভারি জটিল ব্যাপার। সৌভাগ্যের বিষয় তোমাকে ওগুলো বুঝতে হবে না। ঐ সব হিসেব করার ভার মিস্ ব্র্যান্ডের উপর। আলোর স্যুইচগুলো তিনি নেভালেন। সঙ্গে সঙ্গে দেয়ালটা ফাঁকা হয়ে গেল। আর কোন প্রশ্ন আছে? তোমার বিশেষ কিছু করণীয় আছে বলে মনে হয় না। তুমি তো দেখতেই পাচ্ছ এখানকার নিরাপত্তার ব্যাপারে কি রকম কড়াকড়ি। গোড়া থেকেই নিরাপত্তা ব্যবস্থার উপর সরকার খুব জোর দিয়েছিল। বন্ড বলল, মনে হচ্ছে সব কিছু ঠিকঠাক আছে। ড্রাক্সের দিকে তাকাল সে। দেখল তার ভাল চোখটা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। একটু থেমে বন্ড প্রশ্ন করল, আপনার কি মনে হয় আপনার সেক্রেটারি আর মেজর ট্যালনের মধ্যে কোন সম্পর্ক ছিল?
সহজ গলায় ড্রাক্স বললেন, থাকা খুবই স্বাভাবিক। মেয়েটি সুন্দরী। এক সঙ্গে তাদের বহু সময় কাজ করতে হয়েছে। মনে তো হয় বারস-এর মাথা সে ঘুরিয়ে দিয়েছিল।
বন্ড বলল, শুনেছি বন্দুকের নলটা মুখে ভরবার আগে বারৎস্ স্যালুট করে চেঁচিয়ে উঠেছিল হাইল হিটলার বলে। স্থির গলায় ড্রাক্স বললেন, তাই তো শুনেছি। কিন্তু তাতে কি যায় আসে?
ড্রাক্সের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বন্ড জিজ্ঞেস করল, আপনার সব কর্মচারিরা গোঁফ রেখেছে কেন? বন্ডের মনে হল তার প্রশ্নে ড্রাক্স অস্বস্তি পেয়েছেন। পরক্ষণেই তিনি গলা ফাটিয়ে হেসে উঠলেন। বললেন, ওই বুদ্ধিটা আমার নিজস্ব। সব লোকগুলোর মাথা কামানো। সবার পরনেই একধনের ওভারঅল। চেনা কঠিন। তাই সবাইকে বলেছিলাম গোঁফ রাখতে। ওটা এখন একটা প্রায় বাতিক দাঁড়িয়েছে। যুদ্ধের সময় ব্রিটিশ বিমানবহরের মধ্যে যেমন দাঁড়িয়েছিল। ও ব্যাপারটায় কোন গলদ আছে বলে তোমার মনে হয়?
বন্ড বল উঠল, না না। প্রথম দেখলে চমকে উঠতে হয়। মনে হয় প্রত্যেক শিফট-এর জন্য আলাদা আলাদা রঙের বড় বড় হরফে এক একটা সংখ্যা ওদের স্যুটে লেখা থাকলে কাজের অনেক বেশি সুবিধে হত।