শাফট-এর ইস্পাতের মেঝেয় এসে ড্রাক্স থামলেন। তাকালেন উপর দিকে। বন্ডও সেদিকে তাকাল। চারদিকে চোখ ঝলসানো আলো। মাঝে মাঝে লালচে শিখা যেন ঝলসে ঝলসে উঠছে।
অ্যাসবেস্টসের স্যুট পরা একটা লোক একটা আগুন নেভানো যন্ত্রের লালচে নল তুলে ধরেছে। নলটা রকেটের নিচের দিকে।
কল্পনাই করা যায় না–এ রকম একটা সূক্ষ্ম যন্ত্র শুক্রবার আকাশে উড়বে। উড়বে ঘণ্টায় পনের হাজার মাইল বেগে। মনে হল বন্ডের মনের কথা ড্রাক্স যেন পড়ে ফেলেছেন। বললেন। সর্বনাশা কাণ্ড–তাই ভাবছ তো? ওয়াল্টার, এখানে এস। ওয়াল্টার এল।
ড্রাক্স তাকে বললেন, ওয়াল্টার–আমাদের এই দোস্ত, বন্ডকে বলেছিলাম, মুনরেকারটাকে আকাশে ছোঁড়া প্রায় গণহত্যার শামিল।
ওয়াল্টারের মুখের বিহ্বল ভাব দেখে বন্ড অবাক হল না। অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে ড্রাক্স বললেন, অতশত ভাবছটা কি? জেগে ওঠ।
আবার স্বাভাবিক হয়ে উঠল ওয়াল্টারের মুখ। ড্রাক্সের কথায় তার মুখে কাষ্ঠ-হাসি ফুটে উঠল। বলল, খুন?–খুন কথাটা মজাদার।–হা-হা-হা-হো-হো-হো–স্যার হিউগো!
লোকজনদের কি হাসাই না হাসাতে পারেন।…
বকবক করে চলল লোকটা। বক্ করতে করতেই রকেটের লেজের কাছে ড্রাক্সকে নিয়ে এল ওয়াল্টার। পেছনে বন্ড। সেখানকার দশটা লোক তাদের দিকে তাকাল। ড্রাক্স পরিচয় করিয়ে দিলেন, কমান্ডার বন্ড, আমাদের নতুন সিকিউরিটি অফিসার।
লোকগুলো কোন কথা না বলে বন্ডের দিকে তাকাল। সেই দশটা লোকের বিশটা চোখে কোন রকম কৌতূহল নেই।
গ্রাফাইট, গ্রাফাইট-ব্যাপারটা কি?
ওয়াল্টার আর ড্রাক্সের কাছে ঘেঁষে এল লোকেরা। একা দাঁড়িয়ে রইল বন্ড। তাকে কেউ দেখেও দেখল না দেখে বন্ড অবাক হল না। তার নিজের ডিপার্টমেন্টে বাইরের কোন অনভিজ্ঞ লোক এলে ঠিক এদের মতই সে নির্বিকার। থাকত। হয়ত বিরক্ত বোধও করত। লোকগুলোর সম্বন্ধে তার মায়া হল। মাসের পর মাস বেচারাদের জীবনে জটিল বৈজ্ঞানিক কাজ ছাড়া আর কিছুই ছিল না। কাজটা এখন শেষ হয়ে এসেছে। মুক্তি তাদের নাগালের মধ্যে। তা সত্ত্বেও তারা জানে? বন্ড এখানে এসেছে ভারি একটা গুরুদায়িত্ব নিয়ে। তাদের কেউ কি জানে তাদের মধ্যে কোন গোপন শত্রু আছে, রকেটের দুর্বলতার কথাটা কে জানে? বাইরে থেকে দেখলে মনে হয় এটা নিখুঁত একটা দল। কিন্তু চুপচাপ সমস্ত পরিকল্পনাটাকে বানচাল করার কেউ কি চেষ্টা করছে না? তাদের মধ্যে কোন লোক? যাকে ধরতে এসেছে এই লোকটা–বন্ড? রকেটের ডানার তিনটে কোণ একটা ত্রিভুজ সৃষ্টি করেছে। খুব স্বাভাবিক পায়ে বন্ড সেখানে খানিক ঘোরাঘুরি করল। কিন্তু লোকগুলোর দিকে তাকাতে লাগল বিভিন্ন জায়গা থেকে।
ড্রাক্স ছাড়া সবাইকার পরনেই সেই একই ধরনের নাইলনের আঁটসাঁট ওভারঅল আর প্লাস্টিকের জিপ। কোন রকম ধাতুর কোন চিহ্ন নেই, কোথাও কারোর চোখে চশমা নেই। ওয়াল্টার আর ক্রেবস-এর মত সবার মাথাতেই কদমছাট। বন্ড ভাবল ও যন্ত্রপাতির মধ্যে একগাছা চুল যাতে না পড়ে তার জন্যই এই ব্যবস্থা। তবু, তবু কেমন যেন ভূতুড়ে গোছের ব্যাপারটা, ভাবল বন্ড। কি খাপছাড়া কাণ্ড–সবাইকার মুখেই কিন্তু ঝোড়া ঝোড়া গোফ, অথচ মাথায় চুল নেই। লোকগুলোর নানা ধাচের গোঁফ-কারোর কাইজার, কারোর হিটলারের মত। গোফগুলোর নানান ছাট।
অবাক হয়ে ভাবল বন্ড ও কারখানার সবাই গোঁফ রাখে কেন? মাথাগুলো প্রায় কামানো, অথচ ঝোড়া গোঁফ! ব্যাপারটা কি? কেমন যেন কুৎসিত। সবাইকার গোঁফজোড়া একভাবে ছাঁটা থাকলেও তবু না হয় বলার কিছু থাকত। কিন্তু এই বিভিন্ন ছাঁটের গোঁফগুলো দেখলে যে কোন মানুষের মন বিদ্রোহ করতে বাধ্য। লক্ষ্য করার আর কিছু ছিল না। লোকগুলো প্রায় একই মাপের, ছিপছিপে গড়নের। বন্ডের মনে হল, এই কাজের জন্য তাদের যেন কেটে হেঁটে তৈরি করা হয়েছে। ক্রেনগুলোর মধ্যে হাঁটবার আর নিচু নিচু দরজা দিয়ে রকেটের ছোট ছোট খুপরিতে ঢোকার জন্য ছিমছাম চটপটে শরীরের দরকার। তাদের হাতগুলো ধবধবে পরিষ্কার, পায়ে ফেল্টের চটি। কেউ একবারও তার দিকে তাকাল না। তিন দিনের মধ্যে যন্ত্রমানবের মত এই পঞ্চাশ জন জার্মানের আসল মনোভাব আবিষ্কার করা একেবারে অসম্ভব বলে মনে হল। তারপর কথাটা তার মনে পড়ল। এখন আর পঞ্চাশ নয়। ঊনপঞ্চাশ। রোবটদের একজন মুখে বন্দুক দিয়ে ট্রিগার টেনে নিজের খুলিটা উড়িয়ে দিয়েছে।
সেই বারৎস্ লোকটার মনে কি ভাবনা ছিল? শুধু কি একটা মেয়ের জন্য কামনা-বাসনা আর হাই হিটলার? মুনরেকার ছাড়া এই বাকি উনপঞ্চাশটা লোকের মনেও কি সেই একই ভাবনাগুলো রয়েছে।
ডক্টর ওয়াল্টার। এটা আমার আদেশ। কাজ শুরু কর। অনেক সময় নষ্ট হয়েছে। চাপা রাগে ভরা ড্রাক্সের স্বর শুনে বন্ডের চিন্তাসূত্র ছিন্ন হয়ে গেল। কোলামবাইট দিয়ে তৈরি রকেটের তীক্ষ্ণ লেজটা সে তখন হাত দিয়ে পরীক্ষা। করছিল।
লোকগুলো চটপট নিজেদের কাজে চলে গেল। রকেটের এক্সস্টের কাছে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে রইল ওয়াল্টার।
বন্ডের কাছে এলেন ড্রাক্স। মুখটা তার রাগে থমথম করছে।
বিড়বিড় করে তিনি বললেন, গাধা কোথাকার! সব সময়েই ঘাবড়ে রয়েছে।
তারপর মন থেকে তার সহকারীর কথা ঝেড়ে ফেলার জন্যই যেন আচমকা বলে উঠলেন, আমার অফিসে এসো। রকেটের গতিপথটা তোমাকে দেখব। তারপর ঘুমোতে যাবে।