নোটিশের নিচেকার একটা বোতাম টিপলেন ড্রাক্স। একটা এ্যালার্ম বেলের চাপা ঢং-ঢং শব্দ শোনা গেল। ড্রাক্স বললেন, সম্ভবত কেউ অক্সি-এ্যাসিটিলিন নিয়ে কাজ করছে। নয়তো অন্য কোন সূক্ষ্ম কাজ। কেউ আসায় মুহূর্তের জন্য তোক অন্য মনস্ক হয়ে পড়লে চড়া খেসারত দিতে হবে। ঘণ্টা বাজলে সবাই হাতের যন্ত্রপাতি নামায়। তারপর ব্যাপারটা দেখে আবার তুলে নেয় নিজেদের যন্ত্রপাতি।দরজা থেকে সরে পাঁচিলের উপরকার সারিসারি চারফুট চওড়া কতকগুলো ফোকর দেখিয়ে ড্রাক্স বললেন, ভেন্টিলেটার শাট। ভেতরটা ৭০ ডিগ্রিতে এয়ারকন্ডিশন করা।
দরজা খুলল একটা লোক। হাতে তার লোহার ডাণ্ডা, কোমরে রিভলভার। ড্রাক্সের পেছন পেছন ছোটো একটা ঘরের মধ্যে গেল বন্ড। সেই ঘরে শুধু একটা বেঞ্চি আর এক সারি ফেল্টের নতুন চটি। বেঞ্চিতে বসে জুতা খুলতে খুলতে ড্রাক্স বললেন, এই চটিগুলো পরতে হবে। তোমার কোটটাও খোলা। বেশ গরম।
নিজের বগলের মধ্যে লুকোনো পিস্তলের কথা মনে পড়ায় বন্ড বলল, ধন্যবাদ। আমার কিন্তু গরম লাগছে না। বন্ডের মনে হল সে যেন কোন হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারে এসেছে। ড্রাক্সের পেছন পেছন একটা দরজা দিয়ে সে বেরিয়ে এল লোহার সরু এক প্ল্যাটফর্মে। স্পট লাইটের অত্যুজ্জ্বল আলোয় চোখ ধাধিয়ে গেল। চোখে হাত চাপা দিয়ে সে চেপে ধরল সামনের লোহার রেলিং। চোখ থেকে হাত নামাবার পর এমন একটা জমকালো দৃশ্য সে দেখতে পেল, যা তার কল্পনার অতীত। কয়েক মিনিটের জন্য সে যেন বোবা হয়ে গেল। পৃথিবীর সবচেয়ে বিশাল মরাণাস্ত্রের ভয়ঙ্কর সৌন্দর্য ধাধিয়ে দিল তার চোখ দুটো।
.
মুনরেকার
বন্ডের মনে হল যেন একটা প্রকাণ্ড কামানের ঝকঝকে পালিশ-করা নলের মধ্যে সে এসে পড়েছে। মেঝে চল্লিশ ফুট নিচে।
পালিশ করা ধাতুর গোলাকার দেয়াল সেখান থেকে উপর পর্যন্ত উঠে এসেছে। সেখানে ড্রাক্স আর বন্ডকে দেখাচ্ছে যেন দুটো ক্ষুদে ক্ষুদে মাছি। গর্তটা প্রায় ত্রিশ ফুট চওড়া।
রকেটটা ঝকঝক করছে। জাফরি-কাটা গোলাকার ইস্পাতের ফ্রেমের উপর সেটা বসানো। লম্বায় প্রায় পঞ্চাশ ফুট। ঝকঝকে ক্রোম স্টিল দিয়ে তৈরি। দেয়াল থেকে বেরিয়ে আসা দুটো ক্রেনের পুরু রবার মোড়া সরু সরু আঙুল চেপে ধরে রয়েছে রকেটের মাঝখানটা। ড্রাক্স বললেন, সম্ভবত ট্যাঙ্ক থেকে জ্বালানি যাবার জায়গাটা পরীক্ষা করে দেখছে। ডিজাইনটা ভারি জটিল। কেমন দেখছ?
বন্ডের বিস্ময় স্তব্ধ মুখের দিকে তাকিয়ে ড্রাক্স খুশি হলেন। বন্ড বলল, এরকম অদ্ভুত সুন্দর জিনিস জীবনে দেখিনি। ইস্পাতের সেই বিরাট গর্তের মধ্যে বলতে গেলে কোন শব্দই নেই। রকেটের পেছন দিকের লোকগুলোর খুব চাপা অস্পষ্ট কথাবার্তা শুধু গুন গুন করছে। ওপর দিকে আঙুল তুলে ড্রাক্স বললেন, রকেটের সামনের দিকটা এখন পরীক্ষামূলক যন্ত্রপাতি দিয়ে ঠাসা। আমাদের সামনে রয়েছে নানারকমের জাইরো। তারপর নিচ পর্যন্ত প্রায় সবটা জুড়ে জ্বালানির ট্যাঙ্ক। ল্যাজের কাছে আছে টারবাইনগুলো। হাইড্রোজেন পেরোক্সাইড ভেঙে খুব গরম বাষ্প পাওয়া যায়। সেই বাষ্প দিয়ে টারবাইনগুলো ঘোরে। ক্লোরিন আর হাইড্রোজেন মিশিয়ে জ্বালানি তৈরি করা হয়েছে।
বন্ডের দিকে কটমট করে তাকিয়ে তিনি বললেন, মনে রেখো, এটা একেবারে গোপন কথা। বাইরের কেউ জানে না। সেই জ্বালানি টিউব দিয়ে উঠে আসে। মোটরের মধ্যে পৌঁছলেই সেগুলো জ্বলে ওঠে। সেই বিস্ফোরণই রকেটটাকে শূন্যে ছুঁড়ে দেয়। রকেটের তলাকার ইস্পাতের মেঝেটা সরে যায়। নিচে একটা প্রকাণ্ড গহ্বর আছে। পাহাড়ের তলায়। কাল সেটা দেখবে। প্রকাণ্ড একটা গুহার মত দেখতে। সেদিন আমরা যখন পরীক্ষা করি, খড়ি পাথর পানির মত গলে সমুদ্রে গিয়ে পড়ে। রকেটটা ছোঁড়ার সময় আশা করি এই বিখ্যাত পাহাড়গুলো জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে না।
কারখানাটা দেখতে চাও?
ইস্পাতের দেয়ালটার পাশ দিয়ে খাড়া একটা লোহার সিঁড়ি নেমে গেছে। ড্রাক্সের পিছু পিছু চুপচাপ সেই সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগল বন্ড। এই মানুষটার কাণ্ডকারখানা দেখে শ্রদ্ধা ও ভক্তিতে তার মন ভরে উঠল। তাসের টেবিলে ড্রাক্সের ছেলেমানুষি দেখে সে চটে গিয়েছিল ভেবে মনে মনে একটু যেন লজ্জিতই হল সে। এ তো জানা কথা–মহৎ লোকদেরও নানা দুর্বলতা থাকে। ড্রাক্সের মাথায় সাংঘাতিক একটা দায়িত্ব। সেই কারণে তার মধ্যে একটা চাপা উত্তেজনা থাকা এবং সেই উত্তেজনাকে লাঘব করার একটা পথ খোঁজা তার পক্ষে খুবই স্বাভাবিক। ডিনারের সময়কার কথাবার্তা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় দুশ্চিন্তায় উদ্ভ্রান্ত সহকারীর উপর তিনি বিশেষ নির্ভর করতে পারেন না। পুরো দলটাকে উদ্বুদ্ধ করার দায়িত্ব একা তার। বন্ড ভাবল, এত বড় একটা ঝুঁকি নিলে গলগল করে ঘামা আর দাঁতে নখ কাটা খুবই স্বাভাবিক। দীর্ঘ ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে তারা নামতে লাগল। রকেটটার ঝকঝকে ক্রোমিয়ামের গায়ে তাদের প্রতিবিম্বিত ছায়াগুলো দেখতে লাগল কিম্ভুতকিমাকার। জনসাধারণ এই মানুষটাকে যে রকম ভালবাসে, শ্রদ্ধা করে– সেই রকম ভালবাসা ও শ্রদ্ধায় ভরে উঠল বন্ডের মন। অথচ এই মানুষটারই চুলচেরা বিচার করেছিল সে, প্রায় ঘৃণাই করেছিল মানুষটাকে। ভাবতে গিয়ে অবাক হল বন্ড। লজ্জিত হল। কুণ্ঠা বোধ করল।