আহা, চটছ কেন? এমনভাবে ড্রাক্স বললেন, যেন শিশুর সঙ্গে কথা বলছেন। সমস্যাগুলোর কথা পরে আমরা আলোচনা করব। তুমি ছাড়া সবাইকার কোন দুর্ভাবনা নেই। বন্ডের দিকে ফিরে তিনি বললেন, ডক্টর এক সময় আমাদের ভয় দেখায়। সব সময়েই যেন দুঃস্বপ্ন দেখছে। এখন ওর দুর্ভাবনা রকেটের ডানাগুলো নিয়ে। সেগুলো ক্ষুরের মত ধারাল। বাতাসকে মোটেই বাধা দিতে পারবে না। এখন হঠাৎ ডক্টরের মাথায় ঢুকেছে ওগুলো গলে যাবে বাতাসের ঘষা লেগে। সব কিছুই অবশ্য সম্ভব।
কিন্তু ওগুলোকে তিন হাজার ডিগ্রি তাপে পরখ করে নেওয়া হয়েছে। ডক্টরকে বলেছি, ওগুলো গললে পুরো রকেটটাই গলে যাবে–যেটা অসম্ভব। ড্রাক্স-এর হাসি হিংস্র হয়ে উঠল। একটা রূপার ট্রে নিয়ে ক্রেবস এল। তাতে চারটে ভর্তি গ্লাস আর একটা হিম ঠাণ্ডা শেকার। মাটিনিটা চমৎকার। বন্ড তারিফ করল। বোকা বোকা হেসে ক্রেস বলল, অনেক ধন্যবাদ, স্যার হিউগো কোনরকম খুঁত বরদাস্ত করতে পারেন না। ড্রাক্স বললেন, বন্ডের গ্লাসটা ভরে দাও। তারপর ও মুখহাত ধুতে যাবে। আমরা কাঁটায়-কাঁটায় আটটায় ডিনারে বসি। তার কথার পরেই সাইরেনের চাপা শব্দ শোনা গেল। সঙ্গে সঙ্গে দেখা গেল বাইরের কংক্রিট বাঁধানো জায়গা দিয়ে নিখুঁতভাবে পা মিলিয়ে একদল লোককে ছুটতে।
ড্রাক্স বললেন, এটা প্রথম নাইট শিফট। বাড়ির পেছন দিকে ব্যারাক। নিশ্চয় আটটা বাজে। তার চোখের মধ্যে আত্মতৃপ্তির ভাব ফুটে উঠল। একেই বলে নিয়মনিষ্ঠা। এখানে অনেক বৈজ্ঞানিক থাকা সত্ত্বেও মিলিটারি ব্যারাকের মত আমাদের সব আইন কানুন। উইলি, তোমার উপর কম্যান্ডারের দেখাশোনার ভার রইল–এবার খেতে যাওয়া যাক্।
ডিনারের কোন তুলনা হয় না। ড্রাক্সের আতিথ্য একেবারে নিখুঁত। তিনি চাইছিলেন ডাঃ ওয়াল্টারকে দিয়ে কথা বলাতে, যাতে সব কিছু বুঝতে পারে বন্ড। নানান বৈজ্ঞানিক ব্যাপার বুঝিয়ে দিলেন ড্রাক্স। ড্রাক্সের খুঁটিনাটি ব্যাপার সম্বন্ধে জ্ঞান দেখে বন্ড স্তম্ভিত হল। লোকটাকে আন্তরিকভাবে সে তারিফ করতে লাগল। বন্ডের মন থেকে তার প্রতি আগেকার বিদ্বেষ একেবারে মুছে গেছে। এ যেন অন্য এক ড্রাক্স-যার সঙ্গে ব্লেড্রস ক্লাবে তাস খেলার কোন সম্পর্ক নেই। ইনি একজন স্রষ্টা। একজন নেতা-অবিশ্বাস্য একটা কাণ্ড করতে চলেছেন। মিস্ ব্র্যান্ড আর ড্রাক্সের মাঝখানে বসল বন্ড। মেয়েটির সঙ্গে আলাপ করতে গিয়ে হাল ছেড়ে দিতে বাধ্য হল।
হা আর না ছাড়া মেয়েটির মুখে আর কোন কথা নেই। চোখের দিকেও তাকায় না। মনে মনে চটে উঠল বন্ড। ভারি সুন্দরী মেয়েটি। বন্ডের মনে হল মেয়েটির গাম্ভীর্য যেন একটু বেশি বাড়াবাড়ি ধরনের। মুখ গোমড়া করে না থেকে খোলাখুলি হাসিখুশি ভাব দেখানোটাই তার উচিত। তাতে তার আসল কাজেরই সুবিধে-কারুরই কোন রকম সন্দেহ হবে না। তার খুব ইচ্ছে করছিল টেবিলের তলা দিয়ে মেয়েটির পায়ের গোছে জোরে একটা লাথি কষাতে। মেয়েটির দিকে আবার সে এমনভাবে তাকাল যেন সে নিতান্তই সুন্দরী একটি মেয়ে তার সহকর্মিনী নয়। ড্রাক্স আর ওয়ালটার কথা বলছিলেন। সেই আলোচনায় মেয়েটিকে যোগ দিতে হচ্ছিল।
মেয়েটি তার ফটোর চেয়ে অনেক বেশি সুন্দরী। তার চেহারার সঙ্গে মেয়ে পুলিশের দক্ষ হাবভাব ঠিক যেন খাপ খায় না। মুখের মধ্যে কর্তৃত্বের একটা স্পষ্ট আভাস পাওয়া যায়। কিন্তু তার গভীর নীল চোখের উপরকার কালো দীর্ঘ পল্লব আর মুখটা যেন কোন নিপুণ শিল্পীর আঁকা ছবির মত। তার ভাবভঙ্গি যেন একটু বেশি রকম গাম্ভীর্য আর কর্তৃত্বময়–দেখলে নিঃসন্দেহে মনে হয় সে একজন সুদক্ষ সেক্রেটারি। মনে হয় সে যেন ড্রাক্সের দলেরই একজন।
ড্রাক্সের প্রশ্নের উত্তর সে যখন দিচ্ছিল, বন্ড লক্ষ্য করল অন্য দুজন সেটা খুব মন দিয়ে শুনছে। মেয়েটির পোশাক কুচকুচে কালো। হাত দুটো কনুই-এর চেয়ে কিছু বড়। বডিসের ওপরকার ওড়না ভেদ করে দেখা যায় তার উদ্ধত স্তনরেখা। রেকর্ড বইতে তার যে মাপজোপ পড়েছিল, তা থেকে বন্ড অনুমান করল সে দুটি নিশ্চয়ই অপরূপ। তার বুকে একটা উজ্জ্বল নীল পাথরের ব্রু।
সবকিছু মিলিয়ে বন্ডের মনে হল মেয়েটি ভারি সুন্দরী এবং গম্ভীর হলেও খুবই আবেগ প্রবণ প্রকৃতির। ভাবল সে মেয়ে পুলিশ এবং জুজুৎসুতে এক্সপার্ট হতে পারে, তবু তার ডান দিকের স্তনের উপর আছে একটা তিল!
এই সব ভাবনা চুকিয়ে ড্রাক্স আর ওয়ালটারের আলোচনা খুব মন দিয়ে শুনতে লাগল বন্ড। মেয়েটির সঙ্গে ভাব জমাবার আর কোন চেষ্টা করল না। ন-টায় ডিনার শেষ হল। আচমকা টেবিল থেকে উঠে পড়ে ড্রাক্স বললেন, এবার আমার তোমার সঙ্গে মুনরেকারের পরিচয় করিয়ে দেব। ওয়ালটার আমাদের সঙ্গে আসবে। তার অনেক কাজ। চলে এস, ডিয়ার বন্ড। ক্রেবৃস আর মেয়েটির সঙ্গে কোন কথা না বলে লম্বা লম্বা পা ফেলে ঘর থেকে তিনি বেরিয়ে গেলেন। বন্ড আর ওয়ালটার চলল তার পেছন পেছন। বাড়ি থেকে বেরিয়ে কংক্রিট-মোড়া জায়গাটা পেরিয়ে দূরে পাহাড়ের কিনারে আবছা জিনিসটার দিকে তারা এগিয়ে চলল। চাঁদ উঠেছে। দূরের সেই হোঁকা মত জিনিসটা জ্যোৎস্নায় চিকচিক করছে।
জায়গাটা শ খানেক গজ দূরে থেকে ড্রাক্স বললেন, এখানকার ভৌগোলিক অবস্থা তোমাকে বুঝিয়ে দিই। ওয়ালটার, তুমি এগোও। ওরা অপেক্ষা করছে। আর একবার ডানাগুলো তুমি পরখ করে দেখ। ওগুলো নিয়ে দুর্ভাবনা। কর না। বন্ডের দিকে ফিরে দুধের মত সাদা গম্বুজটা দেখিয়ে তিনি বললেন, ওটাই মুনরেকার। যেটা দেখছ সেটা। একটা চওড়া গর্তের ঢাকনা। চল্লিশ ফুট খড়ি পাথর কেটে ওটা বসানো হয়েছে। একদিকে প্রায় অদৃশ্য একটা চৌকোমত জিনিস দেখিয়ে তিনি বললেন, ওটা হচ্ছে রকেট ছোড়বার জায়গা। কংক্রিটে তৈরি। রেডার অনুসরণের বহু যন্ত্রপাতি ওঠার মধ্যে। ওখানে একটা খুব বড় টেলিভিশন পর্দাও আছে, রকেটে কি ঘটছে দেখবার জন্য। আকাশে ওঠার শুরুতে রকেটটা অনুসরণ করার জন্য আরও একটা টেলিভিশন সেট আছে। কংক্রিটের ব্লকের পাশে পাহাড়ের মধ্যে একটা লিস্ট চলে গেছে। সমুদ্র পথে বহু যন্ত্রপাতি এসেছে। ওই লিফ্ট দিয়ে সেগুলো তোলা হয়। ডোভারের দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বললেন, যে ঘ্যানঘেনে শব্দটা শুনেছ সেটা ওখানকার পাওয়া হাউসের। পুরু দেওয়াল দিয়ে বাড়ি আর ব্যারাকগুলো আড়াল করা। কিন্তু যখন রকেটটা ছোঁড়া হবে তখন সরকারি বিশেষজ্ঞ আর B.B.C.-র দল ছাড়া জায়গাটার এক মাইলের মধ্যে কেউ থাকবে না। আশা করি দেওয়ালটা বিস্ফোরণে ভেঙে পড়বে না। ওয়ালটার বলে নিদারুণ তাপে জায়গাটা আর অনেকখানি কংক্রিট গলে যাবে। ভেতরে যাবার আগে আর কিছু দেখার নেই। চলে এস। আবার সেই আচমকা আদেশের সুর, বন্ড লক্ষ্য করল। জ্যোত্সার মধ্যে ড্রাক্সের পেছন পেছন বন্ড চুপচাপ চলল সেই গম্বুজটা আড়াল করা পাঁচিল পর্যন্ত। পাঁচিলের মধ্যে ইস্পাতের দরজার উপর আটকান একটা লালবাতি জ্বলছিল। বড় বড় হরফে লেখা একটা সাইনবোর্ডের উপর সেটার আলো পড়েছে। ইংরেজি এবং জার্মান ভাষায় লেখা ও মারাত্মক বিপদ। লাল বাতি জ্বললে প্রবেশ নিষেধ। ঘন্টা বাজিয়ে অপেক্ষা করুন।