সবগুলো লক্ষণই প্যারানোইয়ার (ভ্ৰম-বাতুলতা) বিরাটত্বের মোহ, তার পেছনে রয়েছে নির্যাতন মনোভাব। এগুলো স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছিল তার মুখের ঘৃণার ভাবে, তার গর্জন ভরা স্বরে, তিক্ত পরাজয়ের পর তার মুখের সেই গোপন বিজয়োল্লাসের অভিব্যক্তির মধ্যে। সেই বিজয়োল্লাসের অভিব্যক্তিটা উন্মাদের মত, যাদের ধারণা–আসল ঘটনা যাই হোক না কেন, তারা অভ্রান্ত। উন্মাদদের ধারণা থাকে, যে-কেউ বাধা দিতে আসুক না কেন, তাকে তারা নির্ঘাত হারিয়ে দেবে। তাদের ধারণা নিজেদের এমন-সব গোপন ক্ষমতা আছে যার দরুন কিছুতেই তারা হারবে না। তাদের ধারণা তার সোনা বানাতে পারে, উড়তে পারে পাখির মত-তারাই সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তা। রিজেন্ট স্ট্রিটের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে বন্ডের মনে হল–এটাই সমস্যাটার একমাত্র উত্তর। স্যার হিউগো ড্রাক্স বদরাগী একজন প্যারাননাই যাকে এই উন্মত্ত ক্ষমতাই নানা সর্পিল পথে কোটি কোটি পাউন্ড সগ্রহ করতে সাহায্য করেছে। প্যারনোইয়াক বলেই তিনি ইংলন্ডকে উপহার দিতে চলেছেন এই অতিকায় রকেটটা, যেটা নির্মূল করবে আমাদের শত্রুদের। ধন্যবাদ সর্ব শক্তিমান ড্রাক্স-কে।
কিন্তু কে বলতে পারে এই মানুষটার পুরোপুরি পাগল হয়ে যেতে আর কত দেরি, তার সেই তর্জন-গর্জন, তাঁর সেই লালচে চুল-ভরা মুখ ভেদ করে কে জানতে পেরেছে আসল কথাটা? তার মধ্যে কে সেই সব সংকেত চিহ্নগুলোর আসল অর্থ পড়তে পেরেছে-যে গুলো তাঁর নিচ বংশ পরিচয় অথবা যুদ্ধক্ষতগুলোর জন্য প্রকট হয়ে ওঠেনি।
হেসে উঠল বন্ড। কি নিয়ে এরকম নাটুকেপনা সে করছে তার কি ক্ষতি করেছে লোকটা? বলতে গেলে ১৫ হাজার পাউন্ড তাকে তো সে উপহার দিয়েছে। কিন্তু তার সেই শেষ মন্তব্যটার মানে কি? কম্যান্ডার বন্ড, এই টাকাটা খুব চটপট খরচ করে ফেল। কথাগুলো তার মনের মধ্যে গেঁথে গিয়েছিল। বন্ডের মনে হল ওই কথা গুলোর দরুনই হয়ত ড্রাক্সের সমস্যা নিয়ে সে মাথা ঘামাচ্ছে।
চটপট জানালা থেকে সরে এল বন্ড। ভাবল চুলোয় যাক; নিজেই দেখছি মোহগ্রস্ত হয়ে পড়েছি। পনের হাজার পাউন্ড একেবারে কল্পনার বাইরে। বেশ কথা, খুব চটপট সে খরচ করে ফেলবে, ডেস্কের সামনে বসে একটা পেনসিল নিয়ে অতি গোপনীয় লেখা ছোট একটা প্যাডে সাবধানে সে লিখে চলল।
১। রোলস-বেন্টলি কনৃভাটিব–প্রায় ৫০০০ পাউন্ড। ২। তিনটে হারের ক্লিপ, প্রত্যেকটা ২৫০ পাউন্ড–৭৫০ পাউন্ড, সে থামল। তখনো বাকি থাকে প্রায় ১০,০০০ পাউন্ড। কিছু পোশাক, নিজের ফ্ল্যাটটা রঙ করা। একসেট নতুন Henry Gottn বাসন, কয়েক ডজন টিটটিনজার শ্যামপেন। কিন্তু এ গুলো পরে হলেও চলবে। আজ বিকেলেই সে যাবে ক্লিপগুলো কিনতে আর বেন্টলি কোম্পানির সঙ্গে কথা বলতে। বাদবাকি টাকায় সে কিনবে সেরা শেয়ার। প্রচুর টাকা হবে তার। তারপর–রিটায়ার।
যেন রেগে আপত্তি জানিয়ে লাল টেলিফোনটা ঘরের স্তব্ধতা চুরমার করে দিল।
আসতে পার? তোমাকে M-এর দরকার। বড় কর্তার স্বর।
আসছি, হঠাৎ অত্যন্ত সতর্ক হয়ে উঠে বলল বন্ড। কি ব্যাপার?
বড়কর্তা বললেন কোন ধারণাই নেই। এ পর্যন্ত কোন সিগন্যালে উনি হাত ছোঁয়াননি। সারা সকাল ছিলেন স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড আর সরবরাহ দপ্তরে।
টেলিফোনটা সে কেটে দিল।
.
নয়া বন্ডের নতুন কাজ
কয়েক মিনিট পরে সেই পরিচিত দরজা ঠেলে বন্ড ভেতরে গেল। দরজার ওপরকার সবুজ আলোটা জ্বলে উঠল।
তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে M বললেন, চেহারাটা বিশ্রী দেখছি, 007, বস। বন্ড বুঝল এটা কাজের ব্যাপার। দ্রুততর হয়ে উঠল তার নাড়ির স্পন্দন। আজ আর জেমস্ নয়, আজ 007। বন্ড বসল। একটা প্যাডে পেন্সিলে কিছু নোট করা ছিল। M সেটা পড়ছিলেন। তিনি মুখ তুললেন। তাঁর চোখে এখন বন্ড সম্বন্ধে আর কোন কৌতূহল নেই।
তিনি বললেন, গত রাত্রে ড্রাক্সের কারখানায় গণ্ডগোল হয়েছে। জোড়া খুন। পুলিশ ড্রাক্সের সন্ধান করেছিল। ব্লেস্-এর কথা তাদের মাথায় আসেনি। রাত প্রায় দেড়টায় রিজ-এ ফিরলে পুলিশ তার সঙ্গে যোগাযোগ করে। কারখানার কাজে একটা বার-এ মুনরেকারের দু-জন লোক গুলি খায়। দু-জনেই মারা গেছে। পুলিশকে ড্রাক্স বলেন মরেছে তো তাতে তার কি? তারপর টেলিফোন কেটে দেন। লোকটার যেমন স্বভাব। এখন তিনি সেখানে। শুনলাম ঘটনাটাকে এখন তিনি একটু গুরুত্ব দিচ্ছেন।
চিন্তিতভাবে বন্ড বলল, অদ্ভুত যোগাযোগ। কিন্তু এর সঙ্গে আমাদের কি সম্পর্ক স্যার? এটা তো পুলিশের কাজ তাই না? M বললেন, আংশিকভাবে, কিন্তু সেখানকার অনেক কর্মচারির জন্য আমরা দায়ী যারা গুরুত্বপূর্ণ পদে আছে। তারা জার্মান। প্যাডের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, ব্যাপারটা খোলসা করে বলি। এটা রাষ্ট্রীয় বিমান বাহিনীর প্রতিষ্ঠান। পূর্ব উপকূল জুড়ে যে বিরাট রেডার ব্যবস্থা রয়েছে এটা তার একটা অংশ। সেখানকার সীমানা পাহারা দেবার দায়িত্ব বিমান বাহিনীর। শুধু কারখানার ওপর সরবরাহ দপ্তরের আধিপত্য। সেখানেই কাজ চলছে। ডোভার আর ডীল-এর মাঝখানকার খাড়া পাহাড়গুলোর কিনারে জায়গাটা; পুরো জায়গাটা হাজার একরের। কিন্তু কারখানাটা প্রায় দুশ একর জুড়ে। সেই কারখানায় এখন আছেন শুধু ড্রাক্স আর বাহান্ন জন কর্মচারি। কনস্ট্রাকশন টিমের আর সবাই চলে গেছে।