ব্যাপারটা যাকে বলে একেবারে খুন খারাপির মত কাণ্ড। প্রায় মোগ্রস্ত মানুষের মত টেবিলের চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে ব্যাসিলডন এসে দাঁড়ালেন মেয়ার এবং M এর মাঝখানে, যাকে তিনি বন্ড আর ড্রাক্সের মুখ ভাল করে লক্ষ্য করতে পারে। তার নিজের মুখ একেবারে ভাবলেশহীন। কিন্তু হাত দুটো তাঁর ঘেমে উঠেছিল ট্রাউজারের পকেটের মধ্যে। যে সাংঘাতিক সাজা ড্রাক্স পেতে চলেছেন, দুরু দুরু বুক নিয়ে তার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। ব্যাসিলডন দেখলেন গুণে গুণে তেরটা চাবুক, যেগুলোর ক্ষতচিহ্ন কোন তাস খেলোয়াড় কোনদিন মুছে ফেলতে পারে না।
অসহিষ্ণু হয়ে ড্রাক্স বললেন, কিছু একটা খেল, ম্যাক্স এখানে রাত ভোর থাকতে পারব না। ব্রাসিলডন মনে মনে বললেন : ওরে গাধা, দশ মিনিটের মধ্যেই তোর মনে হবে প্রথম তাসটা খেলার আগে চেয়ারের মধ্যে মেয়ারের মৃত্যু হলেই ভাল হত।
মেয়ারকে দেখে মনে হল যে-কোন মুহূর্তে তার স্ট্রোক হতে পারে। মুখটা তার মরার মত সাদা, থুতনি থেকে ফোঁটা ফোঁটা ঘাম ঝরছে তার শার্টের ওপর, মেয়ারের মনে হল তার প্রথম তাসটাই সর্বনাশের সূচনা করবে। অনেক ভেবে মনে হল তাঁর হাতে স্পেডস্ এবং হাটস্-এর লম্বা সুট থাকায় ঐ দুটো রঙের কোন তাসই খুব সম্ভব বন্ডের হাতে নেই। তাই তিনি খেললেন ডায়মন্ডস্-এর গোলাম। তিনি যে-কোন তাসই খেলতেন না কেন, তাতে কিছুই ইতর-বিশেষ হত না। M তার হাত টেবিলের ওপর পেতে দিলেন। দেখা গেল তার হাতে কোন ডায়মন্ডস্ নেই। ড্রাক্স তার পার্টনারকে খিজিয়ে উঠলেন, বুন্ধু। আর কোন তাস পেলে না? গেমটা ওদের হাতে তুলে দিতে চাও নাকি? কাদের দলে খেলছ। ভয়ে সিঁটিয়ে উঠলেন মেয়ার। রুমালে মুখ মুছে ভীরু গলায় বললেন, হিউগো মনে হল খেলার পক্ষে এটাই সবচেয়ে ভাল তাস।
কিন্তু ততক্ষণে ড্রাক্স নিজের দুশ্চিন্তা নিয়ে বিব্রত হয়ে পড়েছেন। M-এর হাত থেকে তুরুপ করে ড্রাক্সের ডায়মন্ডস্ এর সায়েব ধরে সঙ্গে সঙ্গে বন্ড খেলল একটা ক্লাবস। ড্রাক্স দিলেন তাঁর নহলা। নহলা দিয়ে পিটটা নিয়ে বন্ড খেলল একটা ডায়মন্ড। তারপর M-এর হাত দিয়ে সেটা তুরুপ করল। ধরা পড়ল ড্রাক্সের টেক্কা। M এর হাত থেকে একটা ক্লাব খেলে বন্ড ধরে নিল ড্রাক্সের গোলাম।
তারপর বন্ড খেলল ক্লাবস-এর টেক্কা। নিজের হাতের সায়েবটা ধরা পড়তে এই প্রথম ড্রাক্স আভাস পেলেন কি ঘটতে চলেছে। উদ্বিগ্ন চোখে বন্ডের দিকে তাকিয়ে সভয়ে তিনি অপেক্ষা করতে লাগলেন পরের তাসটার জন্য। বন্ডের হাতে কি ডায়মন্ডস্ আছে? মেয়ার কি ডায়মন্ডগুলোকে গার্ড করে রাখেননি, তিনিই তো ডায়মন্ড দিয়ে খেলা শুরু করে ছিলেন। ড্রাক্স অপেক্ষা করতে লাগলেন। হাতের ঘামে তাসগুলো তার চটচটে হয়ে উঠল। মাফি ছিলেন বিখ্যাত দাবা খেলোয়াড়। তার একটা অভ্যেস ছিল মারাত্মক। যতক্ষণ না নিঃসন্দেহ হতেন প্রতিপক্ষ আর হার এড়াতে পারবে না, ততক্ষণ খেলা থেকে মুখ তুলতেন না। তারপর নিজের বিরাট মাথাটা ধীরে ধীরে তুলে বোর্ডের অন্য পাশের প্রতিপক্ষের দিকে কৌতূহলী চোখে তাকাতেন। প্রতিপক্ষ সেই চাহনিটা অনুভব করে নম্রভাবে তাকাতো মাফির চোখের দিকে। সেই মুহূর্তে প্রতিপক্ষ বুঝতে পারত আর খেলে লাভ নেই। মাফির চোখেও ফুটে উঠত সেই কথা। প্রতিপক্ষ বুঝতে পারত আত্মসমর্পণ করা ছাড়া গত্যন্তর নেই।
মাফির মতই এবার বন্ড মুখ তুলে সোজা তাকাল ড্রাক্সের দিকে। তারপর ধীরে ধীরে ডায়মন্ডস-এর বিবি বার করে রাখল টেবিলের উপর। তারপর মেয়ারের দান দেবার জন্য অপেক্ষা না করে একে একে চিতিয়ে দিল ৮, ৭, ৬, ৫, ৪ এবং ক্লাস-এর দুটো জেতা তাস।
তারপর ধীরে ধীরে চেয়ারে হেলান দিয়ে শান্ত গলায় বলল, আর খেলে লাভ নেই ড্রাক্স। সঙ্গে সঙ্গে সামনের দিকে ঝুঁকে মেয়ারের হাত থেকে তাসগুলো ছিনিয়ে নিল ড্রাক্স। টেবিলের ওপর সেগুলো চিতিয়ে ফেলে পাগলের মত দেখতে লাগলেন সেখানে জেতবার মত কোন তাস আছে কিনা।
তারপর টেবিলের ওপর ছুঁড়ে ফেললেন নিজের তাসগুলো। মুখটা তার মরার মত সাদা হয়ে উঠল কিন্তু রক্তচক্ষু দুটো ধ্বক-ধ্বক জ্বলতে লাগল বন্ডের দিকে চেয়ে। তারপর টেবিলের ওপরকার অর্থহীন টেক্কা সাহেব, বিবিগুলোর ওপর সজোরে বসালেন প্রচণ্ড এক ঘুসি। নিচু গলায় কেটে-কেটে বন্ডকে তিনি বললেন, তুমি একটা টেবিলের ওপাশ থেকে চাবুকের মত ব্যাসিলডনের স্বর শোনা গেল, হয়েছে হয়েছে ড্রাক্স-চুপ কর। ও-ধরনের কথা এখানে চলবে না। পুরো খেলাটা আমি লক্ষ্য করেছি। তাসের দেনা চুকিয়ে দাও। কোন অভিযোগ থাকলে লিখিতভাবে কমিটির কাছে পেশ কর।
ধীরে ধীরে দাঁড়িয়ে চেয়ার থেকে সরে এস ভিজে লালচে চুলগুলোর মধ্যে আঙুল চালালেন ড্রাক্স। ক্রমশ তাঁর মুখের রঙ স্বাভাবিক হয়ে এল, সেই সঙ্গে ফুটে উঠল একটা ধূর্ত অভিব্যক্তি। বন্ডের দিকে তিনি তাকালেন। তার সুস্থ চোখের মধ্যে অদ্ভুত ধরনের একটা ঘৃণা মেশান বিজয়োল্লাসের দৃষ্টি ফুটে উঠল। বন্ডের কেমন যেন অস্বস্তি হতে লাগল। টেবিলের সবাইকার দিকে একে একে তিনি তাকালেন। সেই একই ঘৃণার দৃষ্টিতে। বললেন গুডনাইট। প্রায় হাজার পনের পাউন্ড আমি ধরি। মেয়ারের ধারটাও আমি শোধ করব।