বন্ডের দিকে তাকিয়ে ব্যাসিলডন হাসলেন। বললেন, শুভসন্ধ্যা। তারপর টেবিলের বাঁ দিক থেকে ডান দিকে হাত ঘোরালেন, মেয়ার, ডেঞ্জারফিল্ড, ড্রাক্স। তারা তিনজনে মুহূর্তের জন্য মুখ তুললেন, টেবিলের সবাইকার উদ্দেশ্যে নড় করে বন্ড জানাল অভিবাদন। তোমরা সবাই অ্যাডমিরালকে চেন, তাস বিলি করতে করতে ব্যাসিলডন যোগ করে দিলেন।
চেয়ারে খানিক ঘুরে বসে হৈ হৈ করে উঠলেন ড্রাক্স, আরে, খোদ অ্যাডমিরাল! তারপর পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন বন্ডের দিকে। বন্ডের চোখে পড়ল তার লালচে গোঁফ আর নিরুত্তাপ গোছের চোখ দুটো। টেবিলের দিকে ফিরে নিজের তাসগুলো কুড়িয়ে নিলেন ড্রাক্স। অধিকাংশ খেলোয়াড় যেমন আলাদা আলাদা রঙের তাসগুলো সাজিয়ে নেয়, ড্রাক্স সেভাবে সাজালেন না। শুধু লাল আর কালো তাসগুলো আলাদা করলেন। কিন্তু সেগুলো এলোমেলো হয়ে রইল। ফলে তার হাতটা আন্দাজ করা পাশের লোকের পক্ষে প্রায় অসম্ভব।
বন্ড জানে যারা খুব সাবধানী তাস খেলোয়াড়, তারা এইভাবেই তাস সাজায়।
ফায়ারপ্লেসের কাছে গিয়ে দাঁড়াল বন্ড। যেখানে দাঁড়িয়েছিল সেখান থেকে মেয়ার-এর হাতটা সে দেখতে পাচ্ছিল। ডানদিকে এক পা সরে সে দেখতে পেল ব্যাসিলডনের হাতটা। স্যার হিউগো ড্রাক্সকে সে দেখতে পাচ্ছিল সোজাসুজি। সে ড্রাক্সকে লক্ষ্য করে চলল। ড্রাক্স কুলকুল করে ঘামছেন। তাঁর কোটের পকেটে এক বাক্স কর্ক-টিপড় ভার্জিনিয়া সিগারেট ছিল। সেটা থেকে বার করে ক্রমাগত তিনি সিগারেট টানছিলেন। তাঁর হাত দুটো বলিষ্ঠ আর দক্ষ। বুড়ো আঙুল দুটো বলিষ্ঠ কিন্তু কদাকার। ড্রাক্সের পোশাক-আশাক খুঁটিয়ে দেখল বন্ড, সেগুলো দামী আর সুরুচির পরিচায়ক।
ড্রাক্স আর ব্যাসিলডনের মাঝখানে বসে পাইপ টানছিলেন M। হঠাৎ তার দিকে ফিরে ড্রাক্স বললেন, অনেকক্ষণ ধরে এই রাবার-এর খেলা চলছে। এতক্ষণ তোমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে বলে দুঃখিত। ডিনারের পর একটা চ্যালেঞ্জ গেম খেলতে রাজি। একদিকে ম্যাক্স আর আমি, অন্য দিকে তুমি আর কম্যান্ডার। দৃঢ় প্রত্যয় ভরা বন্ডের জ্বলজ্বলে চোখ দুটো টেবিলের ওপাশ থেকে M লক্ষ করলেন। একমুখ হেসে বন্ড বলল, নিশ্চয়, এ তো খুব ভাল প্রস্তাব।
প্রথমে M তারপর বন্ডের দিকে তাকিয়ে ড্রাক্স বললেন, রাত নটা নাগাদ তাহলে? নিজের তাসগুলো তুলতে তুলতে বললেন, মনে হচ্ছে ক্যাসিনোর টাকাতেই আমার খেলা চলবে।
চুপচাপ সিঁড়ি দিয়ে নেমে তারা সেক্রেটারির অফিসে পৌঁছল। ঘরটা অন্ধকার ছিল। স্যুইচ টিপে আলো জ্বালিয়ে M গিয়ে বসলেন সেক্রেটারির ডেস্কের সামনেকার স্যুইভেল চেয়ারে। শূন্য ফায়ারপ্লেসের কাছে গিয়ে বন্ড একটা সিগারেট ধরাল। M বন্ডের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন কোন হদিশ পেলে? বন্ড বলল, হ্যাঁ, সত্যিই উনি জোচ্চুরি করেন। শুধু নিজের তাস যখন বিলি করেন তখন। তাঁর সামনেকার সিগারেটের রূপার বাক্স আর লাইটারটা তো আপনি দেখেছেন। সেটা থেকে কখনও তিনি সিগারেট নেন না। সেটার ওপর আঙুলের ছাপ ফেলতে চান না। সেটার কাছ থেকে কখনও তিনি হাত সরান না। চারজনের তাস তিনি নিজের খুব কাছে বিলি করেন। প্রত্যেকটা তাসেরই ছায়া পড়ে কেসটার ওপর। উনি ছায়ার খুব ভাল ব্যবসাদার। আপনাকে আয়নাবাজের কথা বলেছিলাম, বোধহয় মনে আছে। এটাও এক ধরনের আয়নাবাজি পদ্ধতির জোচ্চুরি। অন্য সমস্ত দানে তিনি সাধারণ খেলেন কিন্তু প্রত্যেক চতুর্থ দানে সব তাসগুলো জানা খুব সুবিধের। তিনি যে সব সময় জেতেন তাতে অবাক হবার কিছু নেই। আমার মনে হয় তার কটাক্ষ দৃষ্টি খুব ভাল।
দরজা খুলে ব্যাসিলডন ঘরে এলেন। দরজাটা বন্ধ করে তিনি প্রায় ফেটে পড়লেন।
ড্রাক্সের ঐ হতচ্ছাড়া মুখ-বন্ধ-করা ডাকের কথা বলছি। ডাক দেবার সুযোগ পেলে টনি আর আমি চারটে হার্টের খেলা করতে পারতাম। থ্রি নো ট্রাম্পস ডাকার বুকের পাটা কি করে ওর হল কল্পনা করতে পারছি না। কমিটিকে ব্যাপারটা আমাকে জানাতেই হবে। ১৯১৪–১৮ সালের যুদ্ধের পর থেকে আমাদের ক্লাবে কোন জোচ্চুরির কেস হয়নি। ঘরের মধ্যে তিনি পায়চারি করতে লাগলেন। তারপর ড্রাক্স মানুষটার গুরুত্বের কথা মনে পড়তে ব্লেড ক্লাবের কথা তিনি তাড়াতাড়ি ভুলে গেলেন। বলতে শুরু করলেন, লোকে বলছে রকেটটা তৈরি করতে বেশি দেরি নেই। কিছুটা চিত্তবিনোদনের জন্য সপ্তাহে দু একবার ড্রাক্স এখানে আসে। লোকটা জনসাধারণের কাছে হিরো! সাংঘাতিক ব্যাপার। নিজের দায়িত্বের কথা স্মরণ করে ব্যাসিলডনের বুকের ভেতরটা হিম হয়ে গেল। তিনি বললেন, এই ক্লাবে হাজার হাজার পাউন্ড লোকটা জিতেছে, অন্যরা হেরেছে হাজার হাজার পাউন্ড। অবশ্য আমার হারে কিছু যায় আসে না। কিন্তু ডেঞ্জার ফিল্ডের কপালটা খুব খারাপ যাচ্ছে। কথাটা কমিটিকে জানান ছাড়া আর তো কোন উপায় দেখছি না। কমিটিতে দশ জন আছে। ব্যাপারটা ফাঁস হয়ে যেতে বাধ্য। তারপর কেলেংকারির কথাটা ভাব। লোকে বলে ড্রাক্স ছাড়া মুনরেকার হতে পারে না। কাগজে লিখছে দেশের সমস্ত ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে রকেটটার ওপর। এটা দারুণ সিরিয়াস ব্যাপার, আশাপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন M এবং তারপর বন্ডের দিকে। অন্য কোন উপায় আছে?
বন্ড শান্ত গলায় বলল, তার জোচ্চুরি বন্ধ করা যেতে পারে। তার প্যাঁচেই তাকে কাবু করতে হবে। ব্যাসিলডন খুব জোর দিয়েই বললেন, যা খুশি করতে পার। কি করবে ভাবছ? বন্ডের প্রতিশ্রুতি শুনে তার চোখে আশার আলো জ্বলে উঠল।