অন্ধকার হয়ে এল। তার সামনে চক ছাড়িয়ে আকাশে জ্বলজ্বল করে বিজলি-বাতির একটা বিজ্ঞাপন জ্বলতে নিভতে। শুরু করল। মিলিয়ে আসা আলোর তরঙ্গ নিয়ন বাতিটাকে সচল করে তুলেছে। এই আলো রাত ভোর সক্রিয় থাকবে।
বড় হরফের রক্তবর্ণ অক্ষরগুলো পড়ে চমকে উঠল বন্ড। পথের এক পাশে গাড়িটা থামিয়ে নামল। তারপর রাস্তা পেরিয়ে অন্যপাশে এসে ভাল করে পড়বার চেষ্টা করল আকাশে বিজলি আলোয় লেখা বিজ্ঞাপনের কথাগুলো।
এটা SHELL কোম্পানির বিজ্ঞাপন। আপন মনে হাসতে হাসতে বন্ড গাড়িতে উঠল।
সন্ধ্যের আকাশে বড় বড় রক্তাক্ষরে সেই বাড়িটায় খানিকটা ঢাকা পড়া বিজ্ঞাপনের অক্ষরগুলো দেখে সে চমকে উঠেছিল। বন্ড যে অংশটুকু পড়েছিল সেটা বিজ্ঞাপনের কোন কথাই নয়। সেটার মানে সম্পূর্ণ আলাদা।
বন্ড বার বার যে কথাগুলো জ্বলতে নিভতে দেখেছিল, তা হল এই : HELL IS HERE …HELL IS HERE …HELL IS HERE (এটাই নরক, এটাই নরক, এটাই নরক! )
.
আয়নাবাজ
ক্লক -এর সামনে গাড়ি থামিয়ে পার্ক স্ট্রিটের কোণ ধরে বন্ড এগিয়ে চলল।
গোধূলিতে ব্লেড ক্লাবের সামনেটা খুব সুন্দর দেখাচ্ছিল। আশপাশের বাড়িগুলো থেকে সেটা কয়েক গজ ভেতর দিয়ে। দোতলার তিনটে জানালার পর্দা সরাবার সময় মুহূর্তের জন্য দেখা গেল ইউনিফর্ম পরা এক চাকরকে। সেই বিখ্যাত জুয়ার ঘরে তিনটে বিরাট ঝাড়বাতির একটা জুলছিল। সেটার আলোয় ঘর ঝলমল করছে। স্যইং দরজা ঠেলে বন্ড গেল পোর্টারের পুরনো ধাঁচের ঘরের কাছে। পোর্টারের নাম ব্রেভেট। লোকটি ব্লেডস্ ক্লাবের কাউন্সিলার। গুড ইভিনিং, ব্রেভেট, অ্যাডমিরাল এসেছেন?
ব্ৰেভেট বন্ডকে চিনত। মাঝে মাঝে অতিথি হিসেবে সে এসে থাকে। বলল, গুড ইভিনিং স্যার। তাসের ঘরে অ্যাডমিরাল আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন। ইউনিফর্ম পরা ছোকরা চাকর সিঁড়ির ওপরকার একটা লম্বা দরজা বন্ডের জন্য খুলে ধরল। বন্ড দেখল M এক কোণে একলা বসে পেশেন্স খেলছেন। বন্ডকে আসতে দেখে M বললেন, আরে, এই যে। তাসের টেবিলের সামনেকার একটা চেয়ার দেখিয়ে তিনি তাকে বসতে ইঙ্গিত করলেন। চেয়ারে বসে M এর খেলা দেখতে দেখতে দারুণ হাসি পেল বন্ডের। M-কে এখানে লোকে জানে অ্যাডমিরাল স্যার M, প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের কি যেন একটা। সেন্ট জেমস্ স্ট্রিটের যে-কোন ক্লাবের যে-কোন মেম্বারের মত দেখতে M-কে। আজ সন্ধ্যেতেই তাঁর হাতে রক্তের তাজা ছোপ পড়বে, কিংবা কোন চুরির তদন্তের ব্যাপারে সফল হবেন, কিংবা জানতে পারবেন কোন ন্যক্কারজনক ব্ল্যাকমেল কেসের বীভৎসতার কথা।
আর তাকে দেখেই বা সাধারণ দর্শকের কি মনে হবে যার নাম কম্যান্ডার জেমস বন্ড, প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের সঙ্গে যে জড়িত। বন্ড জানত তার চেহারার মধ্যে এমন একটা বিদেশী ছাপ আছে যাতে তাকে ইংরেজ বলে মনে হয় না। সে জানত তার পক্ষে গা ঢাকা দেওয়া কঠিন। বিশেষ করে ইংল্যান্ডে। গুপ্তচর দপ্তরের এলাকার বাইরে তার কাজ। আজ অবশ্য তার ছদ্মবেশের দরকার নেই।
M একজন ওয়েটারকে ডেকে বলল, ট্যানার, পিকের-এর তাস নিয়ে এস।
অল্পক্ষণের মধ্যেই ওয়েটার পাতলা দু-প্যাকেট তাস নিয়ে এল। M হইস্কির অর্ডার দিলেন। আধ ঘণ্টা ধরে তারা খেলে চলল। খেলা শেষ হতে বন্ড গুণে গুণে তিনটে এক পাউন্ডের নোট M কে দিল। ওরা উঠে পড়ল। ব্রিজের টেবিলে গিয়ে ওরা দেখল ড্রাক্স খেলছেন ব্যাসিলডনের টেবিলে। দশ মিনিট আগে এসেছেন। ঘরের অন্যপাশে ভিড় জমতে শুরু করেছে। গোটা ছয় টেবিলে চলছে ব্রিজ খেলা। M-এর পিছন পিছন আসতে আসতে বন্ড ঘরের নানা দৃশ্য উপভোগ করতে লাগল। দীর্ঘ ঘর পেরিয়ে অন্যদের কাছে আসার সময় সেখানকার গন্ধে ও বর্ণে দ্রুততর হয়ে উঠল তার নাড়ির স্পন্দন, নাসারন্ধ্র হয়ে উঠল সামান্য স্ফুরিত।
বন্ডের দিকে পিছন করে যে খেলোয়াড় বসেছিল, দরাজ গলায় সে চেঁচিয়ে উঠল, ডল-ড্যাম্ ইউ। বন্ড লক্ষ্য করল লোকটার চুল ঘন লালচে। তারপর বাঁ দিকে ফিরে দেখল লর্ড ব্যাসিলডনের একাগ্র মুখের একটা পাশ। ব্লেড়স -এর চেয়ারম্যান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখছিলেন নিজের হাতের তাসগুলো। তিনি বললেন, মাই ডিয়ার ড্রাক্স, আমার হাতটা এমন নিখুঁত যে, রি-ডাবল দিতে বাধ্য হচ্ছি। তারপর পার্টনারের দিকে তাকিয়ে বললেন, টমি, যদি হারি তাহলে হারের টাকা আমি দেব। তার পার্টনার বলল, দূর! মেয়ার ড্রাক্সকে বরঞ্চ তুমি বাঁচাবার চেষ্টা কর।
ড্রাক্স-এর কাঁধের ওপর দিয়ে বন্ড তাকাল। ড্রাক্সের হাতে ছিল ইশকাবন আর হরতনের টেক্কা। চটপট সেই দুটো টেক্কার পিঠ নিয়ে ড্রাক্স আবার হরতন খেললেন। ব্যাসিলডন পিঠটা নিলেন হরতনের সাহেব দিয়ে। ড্রাক্সের বিরুদ্ধে তিতি তাস চালালেন কিন্তু মেয়ার বিবি দিয়ে পিঠটা নিল। চেঁচিয়ে উঠলেন ব্যাসিলডন। হাতের সব তাসগুলো টেবিলে বিছিয়ে কাঁচুমাচু মুখে পার্টনারের দিকে তাকালেন। ড্রাক্স হেসে উঠলেন। তিনি ব্যাসিলডনকে বললেন, এতে লাইনের ওপরে দাঁড়াচ্ছে চার শ পয়েন্ট। তোমার ডিল। তাস বেঁটে তিনি ব্যাসিলডনের দিকে এগিয়ে দিলেন। খেলা চলতে থাকল। বন্ড একটা সিগারেট ধরিয়ে ড্রাক্সের মাথার পেছন দিকটা চিন্তিতভাবে লক্ষ্য করতে লাগল।
M এর স্বরে বন্ডের চিন্তাসূত্র ছিন্ন হল। বেসিল, আমার বন্ধু কম্যান্ডার বন্ডকে মনে পড়ে? ভাবলাম একে এনে আজ সন্ধ্যেয় খানিক ব্রিজ খেলা যাক।