বন্ড আরও বলল, যুদ্ধের পর তিন বছর নাকি তার কোন পাত্তা ছিল না। তারপর পৃথিবীর নানা জায়গা থেকে তার খবর আণরা পেতে শুরু করি। ধাতুর ব্যবসায় প্রথম তার কথা শোনা যায়। কোলাবাইট নামে খুব দামী একটা ধাতুর ব্যবসা তিনি একচেটে করে ফেলেছেন। ঐ ধাতু প্রত্যেকেই এখন চায়। এর গলনাংক অসম্ভব বেশি। এই ধাতু ছাড়া জেট ইঞ্জিন তৈরি করা যায় না। পৃথিবীতে এই ধাতুর পরিমাণ খুবই অল্প। কোন উপায়ে তিনি দশ হাজার পাউন্ড জোগাড় করেন। কারণ সানডে এক্সপ্রেসে লিখেছে ১৯৪৫ সালে টন পিছু তিন হাজার পাউন্ড দিয়ে তিনি তিন টন কোলামবাইট কেনেন। এক আমেরিকান বিমান কারখানায় ঐ ধাতুর খুব জরুরি দরকার পড়ে। তাদের কাছে সেটা বেচে তিনি পাঁচ হাজার পাউন্ড লাভ করেন। তারপর সেই ধাতুর জন্য তিনি বায়না দিয়ে চলেন–ছ মাস, ন মাস, এক বছরের। তিন বছরের মধ্যে এই ধাতু তিনি পুরোপুরি হস্তগত করে ফেলেন। এখন কোলাবাইটের দরকার পড়লে লোককে ছুটতে হয় ড্রাক্সমেটালস্-এর কাছে। ইতিমধ্যে নানা জিনিস তিনি বায়না দিয়ে কিনতে থাকেন, যেগুলো বিক্রি করলে মোটা টাকা লাভ করা যায়। যে সব পণ্য দ্রব্যের দাম বাড়ার সম্ভাবনা সেগুলো আগে থেকে কিনে তিনি এক ধরনের জুয়া খেলতে শুরু করেন। লাভের টাকা তিনি খাটান অন্যান্য ব্যবসায়।
পাইপ টানতে টানতে শান্ত স্থির চোখে বন্ডের দিকে তাকিয়ে রইলেন M।
বন্ড বলে চলল, তার এইসব কাণ্ডকারখানা দেখে স্বভাবতই আমাদের দেশের লোকেরা দারুণ হকচকিয়ে যায়। পণ্যদ্রব্যের দালালরা ক্রমাগত শুনতে থাকে ড্রাক্স-এর নাম। ১৯৫৬ সালের মধ্যে তিনি কোটি টাকার মালিক হয়ে ওঠেন। তারপর ইংল্যান্ডে ফিরে সেই টাকা তিনি খরচ করতে শুরু করেন। ভাল বাড়ি, গাড়ি, মেয়েমানুষ কোনকিছুরই অভাব নেই তার। নানা অপেরায় তাঁর বক্স থাকে রিজার্ভ করা। দুটো প্রমোদতরী আছে তাঁর। ওয়াকার কাপ টিমকে তিনি মোটা টাকা চাঁদা দিয়েছেন। বন্যা পীড়িতদের জন্য দিয়েছেন লক্ষ পাউন্ড। অ্যালবার্ট হলে নার্সদের জন্য করোনেশন বল নাচের ব্যবস্থা তিনি করেছিলেন। এক সপ্তাহ যায় না খবরের কাগজের হেডলাইনে তার নাম ছাপান হয় না। যত দিন যাচ্ছে ততই তিনি ধনী হয়ে উঠছেন। লোকেরা তাঁকে দারুণ ভক্তিশ্রদ্ধা করে। তাঁকে দেখে সাধারণ মানুষের মনে আশার আলো জ্বলে ওঠে।
রাণীর কাছে তাঁর সেই বিস্ময়কর চিঠি ও ইয়োর ম্যাজেস্টি, অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে আমি প্রস্তাব করতে পারি… সানডে এক্সপ্রেস খবরটা মোটা হরফে হেডলাইন দেয় : বিনীত ড্রাক্স।
তারপর ছাপে পুরো খবরটা–একটা বিরাট অ্যাটমিক রকেট বানাবার জন্য বৃটেনকে তিনি তার সমস্ত মজুত কোলাবাইট দান করেছেন। সেই রকেটের পাল্লার মধ্যে পড়বে য়ুরোপের প্রায় সব রাজধানী–যে কোন দেশ লন্ডনের ওপর এ্যাটম বোমা ফেলতে চাইলে তাদের কাছে এই রকেট হবে মুখের মত জবাব। সেটা বানাবার খরচের দরুন নিজের পকেট থেকে তিনি দেবেন এক কোটি পাউন্ড।
তারপর বেশ কয়েক মাস সব চুপচাপ। জনসাধারণ অধৈর্য হয়ে ওঠে। লোকসভায় প্রশ্ন ওঠে। বিপক্ষ দল বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থাসূচক প্রস্তাব তুলতে চায়। তারপর প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেন রাষ্ট্রীয় সরবরাহ দপ্তরের বিশেষজ্ঞরা রকেটের ডিজাইন মনোনীত করেছেন। বৃটেনের জনগণের তরফ থেকে রাণী সানন্দে এই দান গ্রহণ করেন। এবং দাতাকে স্যার উপাধিতে ভূষিত করা হয়।
বন্ড এই অসাধারণ মানুষটির কাহিনী বলতে বলতে প্রায় আত্মহারা হয়ে পড়েছিল। এবারে সে থামল।
M বললেন, হ্যাঁ। খবরের কাগজের হেডলাইনটা মনে পড়ছে? আমাদের জীবনে শান্তি সুপ্রতিষ্ঠিত হল। এক বছর আগে ছাপা হয়েছিল, রকেট তৈরি প্রায় শেষ হতে চলেছে। নাম–মুনরেকার। যে সব খবর পেয়েছি তাতে মনে হয় যা দাবী করা হচ্ছে, রকেটটা তা পুরোপুরি পূরণ করতে পারবে। কিন্তু একটা ব্যাপার কিছুতেই বুঝতে উঠতে পারছি না।
M বন্ডকে বললেন, তুমি যা বললে মোটামুটি তাই। তোমার চেয়ে আমিও বেশি কিছু জানি না। আশ্চর্য কাহিনী। অসাধারণ মানুষ। চট করে কি যেন একটা ভেবে নিলেন, তারপর শান্ত চোখে বন্ডের দিকে তাকিয়ে M বললেন, শুধু একটা ব্যাপার… স্যার হিউগো ড্রাক্স তাস খেলার সময় জোচ্চুরি করেন।
.
তাসের রাজা
M নীরস গলায় মন্তব্য করলেন, একজন কোটিপতি তাস খেলার সময় ঠকান–ব্যাপারটা তোমার অদ্ভুত মনে হয় না?
বন্ড হেসে জবাব দিল, এমন অনেক বড়লোকদের কথা জানি পেশেন্স খেলার সময় যারা নিজেদের সঙ্গেই নিজেরা জোচ্চুরি করে থাকেন। কিন্তু ড্রাক্স সম্পর্কে আমার যেটা ধারণা তার সঙ্গে এটা ঠিক খাপ খাচ্ছে না। কেমন যেন বেমানান। M বললেন, জোছুরি ড্রাক্স এমনভাবে করেন যে, এ পর্যন্ত কেউ তাকে ধরতে পারেনি। সত্যি কথা বলতে কি ব্যাসিলডন ছাড়া মনে হয় না আর কেউ ব্যাপারটা সন্দেহ করেছে। তিনি ব্লেডস ক্লাবের চেয়ারম্যান। আমার কাছে তিনি এসেছিলেন। গুপ্তচর বিভাগের সঙ্গে আমি খানিকটা জড়িত বলে তার একটা ভাসাভাসা ধারণা আছে। অতীতে ছোটখাটো কয়েকটা ব্যাপারে তাকে আমি সাহায্য করেছিলাম। আমার পরামর্শ তিনি চেয়েছেন। বলেছেন, ব্যাপারটা নিয়ে ক্লাবের মধ্যে অবশ্যই তিনি কোনরকম হৈ-চৈ চান না। ড্রাক্সকে এই বোকামির হাত থেকে বাঁচানোই তাঁর প্রধান উদ্দেশ্য। আমাদের সবাইকার মত তিনিও ড্রাক্সকে শ্রদ্ধা করেন। তাই কোন একটা কেলেঙ্কারির আতঙ্কে তিনি রয়েছেন। এ ধরনের কেলেঙ্কারির কথা কিছুতেই ধামাচাপা দেওয়া যায় না। ফলে ব্লেডস থেকে ড্রাক্স-কে পদত্যাগ করতে হবে। তারপর তাঁর পক্ষ নিয়ে তাঁর কোন বন্ধু রুজু করে দেবেন মানহানির মামলা। এ ধরনের সব চিন্তাই ব্যাসিলডনের মাথায় ঘুরছে। এ রকম একটা কাণ্ড ঘটতে পারে বলে আমার বিশ্বাস। যাইহোক আমি বলেছি তাকে সাহায্য করব। বন্ডের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন তাই তোমার সাহায্যের দরকার। গুপ্তচর বাহিনীতে তুমিই সবচেয়ে ভাল তাস খেলোয়াড়–অন্তত তোমার তাই হওয়ার কথা। তুমি জান কি করে টেক্কার পিঠে মোম লাগাতে হয়, যাতে প্যাকেট ভাঙলেই টেক্কার জায়গা খুলে যায়; বড় বড় তাসের পিঠে কি করে ক্ষুর দিয়ে চিহ্ন দিতে হয়। আরও অনেক কায়দা–আস্তিনের ভেতর থেকে যন্ত্রের সাহায্যে হাতের মধ্যে দরকার মত তাস নিয়ে আসা। M বললেন, মনে হয় না ড্রাক্স অতটা পেশাদার ধরনের জোচ্চর। ও সব জোদুরি শেখবার জন্য দিনে অনেক ঘণ্টা ধরে প্র্যাকটিস করা দরকার। এমনও হতে পারে তার তাসের ভাগ্যটা অবিশ্বাস্য রকমের ভাল, কিন্তু সমস্তটাই কেমন যেন খাপছাড়া গোছের তিনি শুধু ব্রিজ খেলেন এবং সব সময় তিনি জেতেন মোটা টাকা। ড্রাক্স কি পদ্ধতি অনুসরণ করেন বলে তোমার ধারণা?