হঠাৎ টেলিফোনের শব্দে ঘরের স্তব্ধতা ভেঙে গেল। টেলিফোন করছিল বড়কর্তা। তিনি বন্ডের সঙ্গে দেখা করতে চান। যাচ্ছি বলে বন্ড রিসিভারটা নামাল। বন্ড সেক্রেটারিকে বলল, M-এর সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছে। তার জন্য সে যেন অপেক্ষা না করে। তারপর নিজের অফিস থেকে বেরিয়ে করিডোর দিয়ে চলল লিফট-এর দিকে।
.
কোলাস বাইটের রাজা
দশতলাটা সব সময়েই ভারি চুপচাপ। লিফ্ট থেকে বেরিয়ে নরম কার্পেট মোড়া করিডোরের বাঁ-দিক ধরে বন্ড চলল সবুজ পর্দা ঢাকা সেই দরজাটার দিকে। টোকা না দিয়ে সেই সবুজ পর্দা ঢাকা দরজা ঠেলে বন্ড ভেতরে গেল। M-এর প্রাইভেট সেক্রেটারি মিস্ মানিপেনি টাইপরাইটার থেকে মুখ তুলে তার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল।
পাশের ঘরের খোলা দরজা দিয়ে বেরিয়ে এল বড়কর্তা। লোকটা বন্ডের সমবয়সী। অতিরিক্ত পরিশ্রমে ক্লান্ত শুকনো মুখে তার সকৌতুক মৃদু হাসি। সে বলল, হাসি মস্করা রাখ। M অপেক্ষা করছেন। তারপর লাঞ্চে আসবে তো?
বন্ড বলল, নিশ্চয়ই। মিস মানিপেনির পাশের দরজা ঠেলে ভিতরে গিয়ে সেটা সে বন্ধ করে দিল। দরজার উপরে জ্বলে উঠল সবুজ একটা আলো। বড়কর্তার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকাল মিস মানিপেনি। দরজা ঠেলে বন্ড যখন ভেতরে এল M তখন তার বিরাট ডেস্কের পেছনে পাইপ ধরাচ্ছিলেন। হঠাৎ তিনি প্রশ্ন করলেন, ছুটিটা ভাল কেটেছে
হ্যাঁ, ধন্যবাদ স্যার, বলল বন্ড। বন্ড তাকাল M-এর সুপরিচিত পোড় খাওয়া মুখটার দিকে। সেই মানুষটার দিকে, যাকে সে আন্তরিক শ্রদ্ধা করে। তাঁর মনের ভাব বুঝতে চেষ্টা করল সে। কিন্তু নিষ্প্রভ। হঠাৎ M নিরুত্তাপ গলায় প্রশ্ন করলেন, জেমস্! তোমার হাতে কি বিশেষ কোন কাজ আছে?
বন্ড বলল, না, স্যার! শুধু ফাইলের কাজ আর যথারীতি প্র্যাকটিস্। আমাকে কোন কাজের জন্য দরকার?
সত্যি বলতে কি–তাই দরকার, কিন্তু আসলে গুপ্তচর দপ্তরের সঙ্গে সেটার কোন সম্পর্ক নেই। এটা একটা নেহাতই ব্যক্তিগত ব্যাপার। মনে হয়েছিল হয়ত তুমি সাহায্য করতে পারবে। কাজটায় তোমার খুব বেশি সময় লাগবে না। একটা মাত্র সন্ধ্যের কাজ। নিশ্চয়ই তুমি এই লোকটির নাম শুনেছ–স্যার হিউগো ড্রাক্স? বন্ড বলল, শুনেছি বই কি! সানডে এক্সপ্রেসে তার জীবনী ছাপা হচ্ছে। আশ্চর্য কাহিনী। M জানতে চাইলেন লোকটির সম্বন্ধে বন্ড আর কি কি জানে। বন্ড বলতে শুরু করল– লোকটি সম্বন্ধে প্রথম কথা তিনি আমাদের জাতীয় বীর হয়ে উঠেছেন। দেশের এখন সবাই তার ভক্ত। সবাই তাঁকে আন্তরিক শ্রদ্ধা করে। তাঁর সমস্ত মুখে যুদ্ধের ক্ষতচিহ্ন। মানুষটা সবজান্তা গোছের। মনে হয় মেয়েরা সে কারণে তাঁর কথা ভেবে রোমাঞ্চিত হয়। নিজের গাঁটের পয়সা জমিয়ে দেশের জন্য যা তিনি করেছেন, মনে হয় সেটা যে কোন সরকারের সাধ্যাতীত। তাঁকে প্রধানমন্ত্রী করার প্রস্তাব জনসাধারণের কাছ থেকে এখনো কেন যে আসেনি, সে কথা ভেবে অবাক হই।
বন্ড লক্ষ্য করল M-এর ঠাণ্ডা চোখ দুটো যেন আরও ঠাণ্ডা হয়ে উঠল। কিন্তু ড্রাক্স সব দিক দিয়েই জীবনে সফল হয়েছেন এবং তার এই সাফল্যকে বন্ডও মনে মনে শ্রদ্ধা করে।
M বলল, বাস্তবিকই তিনি অসাধারণ মানুষ। তবে মনে হয় না তার সম্বন্ধে বেশি কিছু জানি। যুদ্ধ দপ্তর ছাড়া আর কোথাও তাঁর সম্পর্কে কোন ফাইল নেই। M বন্ডকে বললেন, সানডে এক্সপ্রেসে যে কাহিনী ছাপা হয়েছে সংক্ষেপে সেটা বলতে।
বন্ড বলল, তার মধ্যেও বিশেষ কোন তথ্য নেই। ১৯৪৪-এর শীতকালে অর্ডেন আক্রমণ করার সময় জার্মানরা বহু গেরিলা আর অন্তর্ঘাতকের সাহায্য নেয়। এই সব লোকেদের জার্মানরা নাম দিয়েছিল পিশাচ । তারা প্রচুর ক্ষতি করে। ছদ্মবেশ ধরার ব্যাপারে তাদের জুড়ি ছিল না। অর্ডেন তারা দখল করতে পারেনি। আমরা রাইন পার হয়ে যাই কিন্তু সেই দলের কিছু লোক তখনো অর্ডেনে থেকে গিয়ে ধ্বংসমূলক কাজ করে যায়। কিন্তু অবস্থা আয়ত্তের বাইরে চলে যেতে দেখে শেষটায় তারা চটপট সরে পড়ে।
আমেরিকান আর বৃটিশ সৈন্য বাহিনীর মধ্যে পেছন দিকে যে যোগাযোগ হেড কোয়ার্টার্স ছিল সেটাকে তারা উড়িয়ে দেয়। তাদের মধ্যে ছিল মিত্র শক্তির নানা বাহিনীর পাঁচমিশেলী লোক–যেমন আমেরিকান সিগন্যালার, বৃটিশ এ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভার ইত্যাদি। পিশাচ -রা মেস হলদে মাইন দিয়ে উড়িয়ে দেয়, সেই সঙ্গে উড়ে যায় যুদ্ধক্ষেত্রের হাসপাতালের বিরাট একটা অংশ। হতাহত হয়েছিল শ-খানেকের বেশি লোক। আহত ইংরেজদের মধ্যে একজন হলেন ড্রাক্স। তার মুখের আধখানা উড়ে গিয়েছিল। এক বছর ধরে তার একেবারেই কোন রকম স্মৃতিশক্তি ছিল না। এক বছর ধরে তাকে নানা হাসপাতালে ঘোরাবার পর যুদ্ধ দপ্তরের খাতায় নিরুদ্দেশ লোকের তালিকার মধ্যে ড্রাক্সের নাম লেখা হয়। অবশেষে কর্তৃপক্ষ হিউগো ড্রাক্স নামে একজনের নাম পায়। লোকটার তিনকূলে কেউ ছিল না। কাজ করত লিভারপুলের ডকে। এই লোকটার নাম শোনার পর আমাদের ড্রাক্সের মধ্যে খানিকটা কৌতূহল দেখা দেয়। সেই লোকটার ফটো আর শারীরিক বর্ণনার সঙ্গে আমাদের ড্রাক্সের খানিকটা মিল পাওয়া যায়। তারপর থেকে ধীরে ধীরে ড্রাক্সের স্মৃতিশক্তি ফিরে আসতে থাকে। তার মনে পড়তে থাকে খুব ছোটখাটো নানা ঘটনার কথা। ডাক্তারেরা এই সাফল্যে বেশ গর্ব অনুভব করেন। যে বাহিনীতে এই হিউগো ড্রাক্স নিযুক্ত ছিলেন সেখানকার এক কর্মচারিকে যুদ্ধদপ্তর খুঁজে বার করে। সেই লোক হাসপাতালে গিয়ে নিঃসন্দেহে সনাক্ত করে ইনিই সেই ড্রাক্স। কোন সন্দেহ থাকে না। ১৯৪৫ সালে হিউগো ড্রাক্স নামে হাসপাতাল থেকে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে তাঁকে দেওয়া হয় বকেয়া বেতন আর অসমর্থ লোকেদের পুরো পেনশন।