হঠাৎ বন্ডের আঙুল শক্ত কি যেন একটা ঠেকল। সেটা ন্যাশের সেই বই। কি করে সেটা চালাতে হয়? কোনটা সোজা কোটা উল্টো দিক সেটার গুলি তার দিকে না ন্যাশের দিকে ছুটবে মরিয়া হয়ে বন্ড ন্যাশের বিরাট মুখের দিকে তুলে কাপড়ের পুটের তলায় চাপ দিল।
ক্লিক-ক্লিক-ক্লিক-ক্লিক… আঙুলের ওপর একটা তাপ অনুভব করল বন্ড। যে হাত দুটো তা পা ধরে ছিল সেগুলো শিথিল হয়ে গেল। ঘামে চকচকে মুখটা সরে গেল তার কাছ থেকে। ন্যাশের গলা থেকে একটা ভয়ঙ্কর ঘড়ঘড় শব্দ শোনা গেল। তারপর তার দেহটা সজোরে আছড়ে পড়ল মেঝের ওপর। দাঁতে দাঁত চেপে হাঁপাতে-হাঁপাতে বন্ড শুয়ে রইল। দরজার ওপরকার বেগুনী আলোটা ক্রমশ ঝাপসা হয়ে আসছে। মনে হল কামরার নিচেকার ডাইনামোটা নিশ্চয়ই খারাপ। চোখ দুটো জ্বালা করতে লাগল। স্থির হয়ে পড়ে রইল বন্ড।
ট্রেনের শব্দটা ক্রমশ বদলে আসছে। তারপর আবার জ্যোত্মার মধ্যে বেরিয়ে ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেসের গতি মন্থর হল।
বন্ড ক্লান্তভাবে উঠে খড়খড়িটা নামাল। দেখল রেললাইনের ওপর নির্মল জোরাল আলো চকচক করছে সুইজাৰ্ল্যান্ডের আলো।
ধীরে ধীরে ট্রেনটা থামল।
সেই স্তব্ধতার মধ্যে সে শুনতে পেল অস্পষ্ট একটা শব্দ। ন্যাশের মৃত্যু সম্পর্কে নিশ্চিন্ত হয়নি বলে নিজের উপর ভারি বিরক্ত হল বন্ড। তাড়াতাড়ি ঝুঁকে পড়ে সে শুনতে লাগল। বইটা তুলে নিল কে জানে হয়ত দরকার হতে পারে। কিন্তু ন্যাশের শরীরটা একেবারে স্থির। নাড়ি চলছে না। নিঃসন্দেহ লোকটা মরে গেছে।
বসে পড়ে ট্রেন চলার জন্য, অসহিষ্ণু হয়ে বন্ড অপেক্ষা করে। এখন অনেক কাজ। তাতিয়ানা কেমন আছে দেখার আগে কামরাটা পরিষ্কার করা দরকার।
ঝাঁকুনি দিয়ে ট্রেনটা চলতে শুরু করল। অল্পক্ষণের মধ্যেই ট্রেনটা ছুটবে আল্পস-এর পাদদেশ দিয়ে ক্যান্টন ভ্যালেসে।
বন্ড উঠে মৃতদেহের পা ডিঙ্গিয়ে গিয়ে ওপরকার আলোটা জ্বালাল। জায়গাটাকে দেখাচ্ছে ঠিক যেন একটা কসাইখানার মত। মানুষের শরীরে দশ পাইট রক্ত থাকে। অল্পক্ষণের মধ্যেই সমস্ত রক্ত সেখানে ঝরে পড়বে। প্যাসেজের মধ্যে গড়িয়ে না গেলেই বাঁচোয়া। তলার বাঙ্ক থেকে বিছানার চাদরটা তুলে ফালি ফালি করে বন্ড কাজ শুরু করে দিল।
অবশেষে কাজটা শেষ হল–ভিজে ন্যাকড়া দিয়ে মেঝে আর দেয়াল মুছে সাফ করা। ডিজনে নামার জন্য বন্ড সুটকেসগুলো সাজিয়ে রাখল।
পুরো এক কুঁজো পানি বন্ড শেষ করল। তারপর এগিয়ে এসে তাতিয়ানার ফারের কোট ঢাকা কাঁধটা ঝাঁকাতে লাগল।
কোন সাড়া নেই। তবে কি লোকটা মিথ্যে বলেছিল? সেই বিষটা দিয়ে তাতিয়ানাকে কি সে খুন করেছে।
তাতিয়ানার গলায় বন্ড হাত দিল। সেটা গরম, কানের লতিতে জোরে চিমটি কাটল তাতে তাতিয়ানা সামান্য নড়ে কাতরে উঠল। বারবার তার কানে চিমটি কাটার পর তাতিয়ানা জড়ানো গলায় বলল, উঃ অমন করো না?
বন্ডের মুখে হাসি ফুটল। তাকে ক্রমাগত ঝাঁকানোর পর পাশ ফিরে তাতিয়ানা নীল চোখ মেলে তাকিয়ে আবার চোখ বুজল। ঘুমের ওষুধের ঘোর তখনো কাটেনি। ঘুম জড়ানো ক্রুদ্ধ গলায় বলল, কি হয়েছে?
আরো জোরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বন্ড তাকে ক্রমাগত নানা কথা বলে। অবশেষে তাতিয়ানা উঠে বসে শূন্যদৃষ্টিতে তাকাল। বাঙ্ক থেকে বন্ড তার পা দুটো ঝুলিয়ে দিল তারপর নামিয়ে আনল নিচের বাঙ্কে।
তাতিয়ানাকে বীভৎস দেখাচ্ছিল–ঠোঁটদুটো ঝুলে পড়েছে, চোখ ফোলা ফোলা, দৃষ্টি বিহ্বল। চুলগুলো জট পাকালো। একটা ভিজে, তোয়ালে আর চিরুনি নিয়ে বন্ড তাকে পরিচ্ছন্ন করল।
লসানে এলো আর তার একঘন্টা পরে ভাল্লারবেস ফরাসি সীমান্ত। বন্ড করিডোরে এল। কাস্টমস আর পাসপোর্টের লোকেরা তার পাশ দিয়ে কন্ডাক্টরের কেবিনে চলে গেল। পাঁচ মিনিট পরে তারা ট্রেন থেকে নেমে গেল।
কামরায় ফিরে বন্ড দেখল তাতিয়ানা আবার ঘুমিয়ে পড়েছে। বন্ডের হাতে ন্যাশের ঘড়িটায় তখন সাড়ে চারটে। কাজে লেগে গেল বন্ড।
তাতিয়ানা স্বাভাবিক চোখে একবার চোখ মেলে তাকিয়ে আবার চোখ বুঝল।
বন্ড করিডোর দিয়ে একে একে ব্যাগগুলো নিয়ে বেরোবার দরজার কাছে জড় করল। তারপর কন্ডাক্টারের কেবিনে গিয়ে জানাল, মাদামের শরীর ভাল নয়, তারা ডিজনে নামবে।
বলল, আপনি ব্যস্ত হবেন না। মাদামের ব্যাঘাত যাতে না হয় তার জন্য মালপত্র নিজেই বার করেছি। আমার বন্ধু, যার চুলগুলো সাদা, তিনি ডাক্তার। সমস্ত রাত তিনি জেগে ছিলেন। আমার বাঙ্কে তাকে ঘুম পাড়িয়ে এসেছি। প্যারিসে পৌঁছবার দশ মিনিট আগে তাকে জাগালেই হবে।
নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই, মশিয়ে গদগদ কণ্ঠে বলল, এত টাকার বকশিশ আগে একমাত্র কোটিপতি যাত্রীদের কাছেই সে পেয়েছিল। বন্ডকে পাসপোের্ট আর টিকিট সে ফিরিয়ে দিল।
কামরায় ফিরে বন্ড তাতিয়ানাকে দাঁড় করিয়ে ধরে করিডোরে নিয়ে এল। তারপর দরজাটা বন্ড বন্ধ করে দিল। ভিতরের বাঙ্কে রইল মৃত্যুর সাদা স্তূপ।
অবশেষে তারা নামল অদ্ভুত সুন্দর শান্ত প্ল্যাটফর্মে। একজন নীল পোশাক পরা পোর্টার তাদের মালপত্র তুলে নিল।
সূর্য সবে উঠতে শুরু করেছে। বেশির ভাগ যাত্রীরই তখন ঘুম ভাঙেনি। থার্ড ক্লাসের মাত্র কয়েকজন যাত্রীই শুধু দেখল ধুলোটে কামরা থেকে একজন তরুণ এক তরুণীর হাত ধরে নিয়ে চলেছে।