সামনের ট্রেনের গুড় গুড় শব্দটা হল গুরুগম্ভীর গর্জন।
আর মাত্র কয়েক সেকেন্ড। আর মাত্র কয়েক গজ।
সাদা পাতাগুলোর মধ্যে সেই ডিমের মত পিস্তলের মুখটা তার দিকে তাকিয়ে আছে। এক সেকেন্ডের মধ্যে অন্ধকার টানেল বই-এর সাদা পাতাগুলে থেকে জ্যোত্সকে মুছে দেবে আর সেখান থেকে তার দিকে লক্ করে ছুটে আসবে সেই নীল জিভটা।
সুখের স্বপ্ন দেখ, হারামজাদা ইংরেজ।
ট্রেনের সেই গুরুগম্ভীর শব্দটা কামান গর্জন হয়ে উঠল। বইটার পুট থেকে ঝলছে উঠল আগুন।
দু গজ দূরে থেকে বুলেটটা ছুটে এল বন্ডের হার্টের ওপর। মেঝের ওপর বড় লুটিয়ে পড়ল।
.
এক বালতি রক্ত
সব কিছু নির্ভর করছিল লোকটার নিখুঁত টিপের ওপর। ন্যাশ বলেছিল বন্ডের হার্টে একটিমাত্র বুলেট যাবে। তার কথায় বিশ্বাস করে জুয়াড়ীর মত দারুণ একটা ঝুঁকি নিল বন্ড। দেখা গেল ন্যাশ মিথ্যে বলেনি।
মরা মানুষের মত বন্ড পড়ে রইল। বুলেটটা আসার আগে তার দেখা নানা মৃতদেহের কথা স্মরণ করেছিল সে। হাত পা ছড়িয়ে ভাঙা পুতুলের মত সম্পূর্ণ নির্জীবের মত সে পড়ে রইল।
বুলেটটা যেখানে বইটাকে বিঁধেছিল তার নিচেকার পাঁজরের হাড়ে যেন আগুন ধরে গিয়েছিল। বুলেটটা নিশ্চয়ই তার সিগারেট কেস ভেদ করে বইটার বাকি অর্ধেকটা ফুঁড়ে বেরিয়েছিল। হার্টের ওপর সে অনুভব করল সীসেটার উত্তাপ। মনে হল সেটা যেন তার পাঁজরের হাড়গুলোকে পোড়াচ্ছে। কাঠের মেঝেয়, তার মাথায় যেখানে লেগেছিল তীব্র যন্ত্রণা। তার নাকের সামনে বেগুনী আলোয় চকচকে একটা জুতার ডগা। এই দুটো ব্যাপার থেকে বন্ড বুঝল সে মরেনি।
প্রত্নতত্ত্ববিদের মত নিজের বিধ্বস্ত শরীরটাকে বন্ড মনে মনে খুটিয়ে পরীক্ষা করে চলল–ছড়ানো পা দুটোর অবস্থা, আধ বাধা হাঁটু, প্রয়োজনের সময় উঠতে সাহায্য করবে। আর ডান হাতটা দেখলে মনে হয় এই হাত তার বিদীর্ণ হার্টকে খামচে ধরার চেষ্টা করেছে। বই থেকে সরাবার পর হাতটা পৌঁছায় তার ছোট্ট এ্যাটাটি কেসটার কয়েক ইঞ্চির মধ্যে, যেখানে লুকানো আছে ক্ষুরের মত দু দিকে ধার দেওয়া ছোড়বার ছুরিগুলো। ছুরিগুলো লুকানো আছে এ্যাটাচি কেসটার সেলাইকরা একটা পাশে। যে কোন জায়গায় চাপ দিলে সেটা বেরিয়ে আসবে। QBranch যখন তাকে দেখায় বন্ড তখন তাদের ঠাট্টা করেছিল। মরার হাতের মত বাঁ হাতটা প্রসারিত। প্রয়োজন মত এটাও তাকে উঠতে সাহায্য করবে।
ওপর দিকে থেকে ভেসে এল প্রকাণ্ড একটা হাই তোলার শব্দ। জুতার দামী ডগাটা সরল। দাঁড়িয়ে উঠল ন্যাশ। এক মিনিটের মধ্যে ডান হাতে বন্ডের পিস্তলটা নিয়ে তুলার বাঙ্কে উঠে চুলের মধ্যে হাতড়ে ন্যাশ খুঁজবে তাতিয়ানার ঘাড়। তারপর বেরেটার নলটা সেখানে চেপে সে ট্রিগার টিপবে। ট্রেনের গর্জনে পিস্তলের শব্দ চাপা পড়ে যাবে।
মরিয়ার মত বন্ড ভাবতে চেষ্টা করল সহজ এ্যানাটমির কথা। পুরুষ দেহের নিম্নাংশের কোন কোন জায়গা প্রাণঘাতী? কোন্খান দিয়ে প্রধান শরীরটা চলে গেছে। কোথায় উরুর হাড় (Fomoral) আর পেছনের হাড় (lliac) মিশেছে। কুঁচকির ঠিক মাঝখানে। মোক্ষম জায়গাগুলোয় আঘাত করতে না পারলে যে সমূহ বিপদ ভাল করেই সে কথা বন্ডের জানা। এই দৈত্যের মত লোকটাকে খালি হাতে কায়দা করা অসম্ভব। ছুরির প্রথম আঘাতটা চরম আঘাত হওয়া দরকার।
জুতার বাদামী ডগাটা বাঙ্কের দিকে ফিরল। লোকটা করেছে কি কোন সাড়া শব্দ নেই। শুধু ট্রেনের ঝনঝন। সেই নকল দাঁত রাখার গ্লাসটার টুংটাং। কুপের কাঠের ফ্রেমের কাঁচকাঁচ আওয়াজ। এই ছোট্ট মৃত্যু-কুঠুরির দু-পাশে। সারিসারি লোক হয় ঘুমুচ্ছে, নয় জেগে জেগে ভাবছে তাদের জীবন, তাদের প্রেম, তাদের ছোট-ছোট প্ল্যানের কথা। হয়ত ভাবছে গেয়ার দ্য লায়নে কারা আসবে তাদের সঙ্গে দেখা করতে। তারা জানে না তাদের সঙ্গে চলেছে স্বয়ং মৃত্যু। একটা বাদামী জুতা মেঝে থেকে উঠল। বন্ডকে ডিঙিয়ে সেটা যাবে। বন্ডের মাথার ওপর প্রসারিত হবে তার দেহের সেই মোক্ষম খাজটা।
সাপের মত পাকিয়ে উঠল বন্ডের পেশীগুলো। তার ডান হাতটা সামান্য সরে স্পর্শ করল কেসটার পাশ। সামান্য চাপ দিতে বেরিয়ে এল ছুরিটার সরু ঠোঁট। হাত না সরিয়ে সেটার অর্ধেকটা বড় টেনে বার করল।
জুতার বাদামী গোড়ালীটা মেঝে থেকে উঠল! এবার দ্বিতীয় পা-টাও উঠে গেল মেঝে থেকে। হঠাৎ তড়াং করে মেঝে থেকে লাফিয়ে উঠল বন্ড। ঝলসে উঠল তার ছুরি।
শরীরের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে ছুরিটা চালিয়ে সামনের দিকে সেটা বন্ড ঠেলতে লাগল।
ওপর থেকে ভেসে উঠল জন্তুর মত একটা আর্তনাদ। ঠঠ শব্দ করে বেরেটা-টা মেঝেয় পড়ল। লোকটার দেহ দারুণ জোরে কুঁকড়ে উঠে পড়ল মেঝেয় আছড়ে। সঙ্গে সঙ্গে বন্ডের মুঠো থেকে ছুরির বাটটা খসে গেল।
ন্যাশ যে পড়বে সেটা বন্ডের জানা ছিল। কিন্তু জানলার কাছে সে সরে যাবার সময় সজোরে একটা হাত আঘাত করে নিচের বাকের ওপর তাকে যে ছিটকে ফেলবে সে কথাটা জানা ছিল না।
আধ-শোয়া অবস্থায় সজোরে লাথি চালাল বন্ড। কিন্তু ন্যাশের অন্য হাতটা তখন তার উরু চেপে ধরেছে। সেখানে ন্যাশের নোখ ফুটতে লাগল।
বন্ডের শরীরটা মোচড়াতে মোচড়াতে টেনে নামাতে লাগল ন্যাশ। অল্পক্ষণের মধ্যেই তার ওপর নেমে আসবে ন্যাশের ধারাল দাঁত। অন্য পা দিয়ে বন্ড লাথি মারতে লাগল। কিন্তু বন্ড বুঝল তার সময় ঘনিয়ে এসেছে।