নিজের হাতের তালুতে বন্ড নোখ বেঁধাল।
ওল্ডম্যান, ট্রিয়েন্টে আমি তোমাকে খুঁজে নিইনি। ট্রেনের সামনের দিকে চড়ে তোমাদের সঙ্গেই এসেছি। ট্রেন থামলে প্লাটফর্মে নেমে পায়চারি করেছি। জানো, ওল্ডম্যান। বেলগ্রেডে তোমার জন্য ওৎ পেতেছিলাম। জানতাম তুমি টেলিফোন করবে–হয় তোমার কর্তা, নয় এমব্যাসি, নয়ত আর কাউকে। যুগোশ্লাভের টেলিফোন কয়েক সপ্তাহ ধরে আমরা শুনেছি। দুঃখের বিষয় ইস্তাম্বুলে যে সাংকেতিক ভাষায় তোমার সঙ্গে কথা বলা হয়েছিল সেটা আমরা বুঝতে পারিনি। তাহলে আমাদের দলের অনেকগুলো তোক বেঁচে যেত। কিন্তু, ওল্ড ম্যান, প্রধান টার্গেট ছিলে তুমি। তুরস্কে যে মুহূর্তে প্লেন থেকে তুমি নামলে তোমাকে আমরা ভরে ফেলি বধ করার বোতলে। শুধু প্রশ্ন ছিল কখন আমরা ছিপিটা আটকাব। ন্যাশ চটপট তার ঘড়ি দেখে বলল, আর দেরি নেই ওন্ডম্যান। ছিপিটা আটতে আর) পনের মিনিট বাকি।
বন্ড ভাবল ও আমরা জানতাম SMERSH খুব দক্ষ। কিন্তু এতটা দক্ষ বলে কখনো কল্পনা করিনি। এই তথ্যটা অত্যন্ত জরুরী। যেমন করেই হোক এটা তাকে তার দপ্তরে পৌঁছে দিতে হবে, দিতেই হবে তাকে। তার মাথায় অতি তুচ্ছ একটা প্ল্যান এসেছে। মরিয়া হয়ে সেই প্ল্যানটারই নানা খুঁটিনাটি সে দ্রুত ভেবে চলল।
সে বলল, মনে হচ্ছে SMERSH সবকিছু খুব খুঁটিয়ে দেখেছে। তার জন্য SMERSH কে নিশ্চয়ই অনেক মেহনত করতে হয়েছে। শুধু একটা কথা…বন্ড থেমে গেল।
কি সেটা, ওল্ডম্যান নিজের রিপোর্টের কথা চিন্তা করে ন্যাশ সজাগ হল।
ট্রেনের গতি মন্থর হয়ে এল। দমোদোসেগল। ইটালিয়ান সীমান্ত। কাস্টমস্ এর লোকেরা আসবে না। তারপর বন্ডের মনে পড়ল। ফ্রান্সের সীমান্ত ভালুবৃরেসে পৌঁছবার আগে ফ্র কামরাগুলোর কাস্টমস্ (চেক-আপ করা হয় না। এমন কি সেখানেও মিপিং কারে কাস্টমস্-এর লোকেরা আসে না। এই এক্সপ্রেস ট্রেনগুলো সুইজাল্যান্ডের মধ্যে দিয়ে সোজা চলে যায়। ব্রিগ কিংবা লসান্নেতে যে সব যাত্রীরা নামে স্টেশনে শুধু তাদেরই কাস্টমস্ রেডার মধ্যে যেতে হয়।
বলে ফেল ওল্ডম্যান। মনে হল ন্যাশ টোপ ধরেছে।
আগে একটা সিগারেট খেতে দাও।
বেশ, খেয়ে নাও। কিন্তু তোমার কোন নড়ন চড়ন আমার পছন্দ না হলেই তুমি মরবে মনে রেখ।
বন্ড ডান হাত হিপ পকেটে ঢুকিয়ে তার পেতলের পুরু সিগারেট কেসটা বার করে খুলে সিগারেট নিল। ট্রাউজারের পকেট থেকে লাইটার বার করে সিগারেট ধরিয়ে রাখল ট্রাউজারের পকেটে। বইটার পাশে রাখল সিগারেট কেসটা। অতি সহজভাবে বাঁ হাতটা রাখল বই আর সিগারেট কেসটার ওপর, মনে হয় হাতটা রেখেছে কোলের ওপর সেগুলো ধরে রাখার জন্য। সিগারেটটা টেনে চলল সে। ভাবল সেটা সিগারেট না হয়ে যদি ম্যাগনেসিয়ামে ফ্লেয়ার বা ঐ জাতের কিছু হত, সেটা ছোঁড়া যেত লোকটার মুখে! কিন্তু যাকগে সে ভাবনা। অন্তত আর একটা উদ্দেশ্য সফল হয়েছে এবং সেটা করতে গিয়ে গুলি খেয়ে সে মরেনি।
মনে হচ্ছে প্ল্যানটার কোন খুঁত নেই। কিন্তু-ন্যাশের মনোযোগ বিক্ষিপ্ত করার জন্য সিগারেট দিয়ে শূন্যে একটা বৃত্ত আঁকল বন্ড, নিঃশব্দে চ্যাপ্টা সিগারেট কেসটা রাখল তার বইটার পাতাগুলোর মধ্যে কিন্তু তোমার কি হবে? সিমপ্লন থেকে বেরুবার পর কি করবে? কন্ডাক্টার জানে আমাদের সঙ্গে তোমার পরিচয় আছে। সঙ্গে সঙ্গে ধরবে তারা।
ও, এই কথা, আবার ন্যাশের স্বরে একঘেয়েমির বিরক্তি ফুটে উঠল। তুমি মনে করেছ রুশীরা সেটা ভাবেনি। ডিজনে নেমে একটা গাড়ি নিয়ে প্যারিসে আমি যাব। আর আমার পাত্তা কেউ পাবে না। গল্পের মধ্যে তৃতীয় একটা লোকের কথা খানিক থাকতে পারে। তাতে ক্ষতি নেই। যাক সে কথা পরে হবে–তোমার হার্ট থেকে দ্বিতীয় বুলেটটা বার করার পর দ্বিতীয় পিস্তলটা যখন তারা খুঁজে পাবে না তখন। আমাকে তারা ছুঁতে পারবে না।
আসলে কাল দুপুরে আমার একটা এ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে–রি হোটেল, রুম নম্বর ২০৪। রোজার কাছে আমাকে রিপোর্ট দাখিল করতে হবে। এই কাজের জন্য সে সুখ্যাতি চায়। তারপর আমি তার শোফার সেজে গাড়িতে বার্লিনে যাব। হঠাৎ ন্যাশের স্বরের মধ্যে একটা আবেগ আর লোভের সুর ফুটে উঠল। জানো ওল্ডম্যান, হয়ত রোজার ব্যাগে আমার জন্য অর্ডার অফ লেনিন ভরা আছে।
ট্রেনটা চলতে লাগল। উত্তেজনায় টান টান হয়ে উঠল বন্ডের শরীর। কয়েক মিনিটের মধ্যে ঘটনাটা ঘটবে। যদি সে মরে তাহলে সেই মৃত্যুটা কি কুৎসিত! যদি মরে মরবে নিজের বোকামীর জন্য–অন্ধ মারাত্মক বোকামীর জন্য। তার বোকামীর জন্য তাতিয়ানাও মরবে। সে সুযোগ পেলেও কাজে লাগায়নি কারণ আত্মভিমান, কৌতুক আর চারদিনের প্রেম করার লোভে সে যে গা ভাসিয়ে দেবে তা রুশীরা জানত। এটাই সমস্ত ব্যাপারটা কুৎসিত দিক SMERSH-এর বিজয়। যে শত্রুকে হারাবে বলে সর্বদাই বন্ড প্রতিজ্ঞা করে এসেছে। বন্ডের মনে পড়ল তাতিয়ানার সঙ্গে তার প্রথম রাত্রি যাপনের কথা। মনে পড়ল সেই কালো মোজা আর ভেলভেটের রিবনটাকে। নিজের প্ল্যান মাফিক SMERSH তখন তার ওপর দৃষ্টি রেখেছিল। লক্ষ্য করছিল আত্মাভিমানীর মত তাকে এগিয়ে যেতে। সেই সঙ্গে ধাপে ধাপে তারা গড়ে তুলেছিল একটা কলঙ্কের কাহিনী। কলঙ্ক তার, কলঙ্ক M-এর যিনি তাকে পাঠিয়েছিলেন ইস্তাম্বুলে, কলঙ্ক ব্রিটিশ গোয়েন্দা দপ্তরের যার প্রধান গর্ব হচ্ছে বন্ড। হায় সৃষ্টিকর্তা, কি বিশ্রী কাণ্ড। শুধু এখন যদি তার নেহাৎ পলকা প্ল্যানটা সফল হয়…।