চূড়ার সেই উঁচু জায়গাটায় পৌঁছবার জন্য শেষ চড়াইটুকু ভাঙবার সময়ে হিমবাহের ধার ঘেঁষে যেতে হল। সতর্কতার সঙ্গে মেজর হিমবাহের বিস্তার আর গভীরতার আন্দাজ ছকে রাখলেন। বিশ্রাম কুটিরের তলাকার ক্ষয়ে যাওয়া কাঠের পাটাতনগুলো দেখা যাচ্ছে। ঢালের গড়নটা মনে মনে যাচাই করে নিলেন মেজর স্মিথ।
বিশ্রাম কুটিরে পৌঁছতে মোট পাঁচ ঘণ্টা সময় লাগল। ১২০ পা যাবার পর ছোট ছোট পাথরের একটা ঢিবি দেখতে পাওয়া গেল। স্মিথের ইচ্ছা হল দু হাতে পাথরগুলো সরিয়ে ফাঁক করে দেন। কিন্তু তা করলেন না। তার বদলে ওয়েবুলি অ্যান্ড স্কটটা বের করে নিলেন। নলের ভেতর চোখ লাগিয়ে দেখলেন, সিলিন্ডারটা ঘুরিয়ে দিলেন। তারপর ফিরে চললেন।
ওপরে বেশ ঠাণ্ডা, দশ হাজারেরও বেশি উঁচু হবে। ওবারহসার কুটির ঢুকে আগুন জ্বালাবার চেষ্টা করতেই আঁৎকে উঠলেন স্মিথ, যদি কেউ ধোয়া দেখে ফেলে। মনের ভাবটা চেপে ডাকলেন, ওবাহসার, কোথায় কি দেখবার আছে, বাইরে এসে বলে গেলে ভাল হয়।
নিশ্চয় যাব, মেজর। মেজর স্মিথের পিছন পিছন কুটিরের বাইরে এল ওবাহসার। পিছনের পকেট হাতড়ে কাগজের মোড়ক বের করল একটা। তার ভিতরে দেখা গেল শুকনো খটখটে কোঁকড়ানো একটা ম্যাসেজ। মেজরের দিকে বাড়িয়ে ধরল। বলল, তেমন কিছু নয়, আমরা একে বলি সডাট। সেঁকা মাংস। শক্ত হলেও খেতে মন্দ নয়।
ঘরে ঢুকতে-না-চুকতেই চট করে বেরিয়ে এল ওবাহসার। নানারকম দৃশ্য, এটা-সেটা দেখাতে দেখাতে কথায় কথায় ওবাহসারকে সামনে রেখে পিছিয়ে রইলেন স্মিথ।
ওপরে পাহাড়ের কিনারায় এসে পৌঁছলেন। নিচে হিমবাহ। মেজর রিভলভারটা বাগিয়ে ধরলেন, দু ফুটের ব্যবধানে পরপর দুটো বুলেট ছুঁড়লেন হ্যাঁনৃস্ ওবাহসার-এর খুলির নিচে।
বুলেটের ধাক্কায় ওবাহসার পাহাড়ের কিনারা থেকে সটান নিচে পড়ে গেছে। হিমবাহের বরফস্রোতের ওপর আছড়ে পড়েছে। গুলির শব্দ দুটো ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল। শেষবারের মত একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে পাহাড়ের কাঁধ বেয়ে দ্রুত পায়ে পুরানো জায়গায় ফিরে চললেন মেজর স্মিথ। পাথরের ঢিবিটার নুড়ি আর পাথরের টুকরোগুলোসমেত হন্যের মত নামতে লাগলেন, যেন শয়তানের তাড়া খেয়েছেন মনে হয়। ভারি পাহাড়গুলো এলোপাথাড়ি গড়িয়ে দিতে লাগলেন ঢাল বেয়ে। কয়েকটা পাথর তখনো বিছানো রয়েছে। পাগলের মত ঘাঁটতে ঘটতে পাথর সরিয়ে দেখতে পেলেন একটা লোহার বাক্স। সাফল্যের একটা উৎকট শব্দ বের হয়ে এল মেজরের মুখ থেকে। একটা শক্ত পাথরের ওপর বসে ভবিষ্যতের সুখস্বপ্নে বিভোর হয়ে রইলেন। হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে চটপট উঠে পড়লেন। বাক্সটাকে কোনরকমে ধরে টেনে-হিঁচড়ে কুটির পর্যন্ত নিয়ে গেলেন। ভাবতে লাগলেন, পঞ্চাশ হাজার পাউন্ডের এই সম্পত্তি পাহাড় বেয়ে নামিয়ে কি করে নতুন কোনও জায়গায় লুকিয়ে রাখা যায়।
মেজর স্মিথ এখন একটা মারাত্মক অপরাধী। তিনি এখন রক্ষক থেকে ভক্ষক হয়েছেন। কথাটা মনে না রাখলেই সর্বনাশ। ভুলে গেলেই মৃত্যু! অশেষ যন্ত্রণা সয়ে যেতে হবে। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা জানেন সত্যই সে যন্ত্রণার শেষ হবে না কোনদিন। তবে বাকি জীবনটুকু সুখ-স্বাচ্ছন্দে কাটাতে পারবেন। কুটিরে যে কেউ এসেছিল, তার যা কিছু লক্ষণ থাকা সম্ভব অতিরিক্ত সতর্কতার সঙ্গে তা নিশ্চিহ্ন করলেন মেজর। বাক্সটাকে পাথরের কিনারায় টেনে আনলেন। হিমবাহের দিকটা এড়িয়ে নিচের দিকে তাক করে শূন্যে ছুঁড়ে দিলেন।
শূন্যে ঘুরপাক খেতে খেতে বাক্সটা নিচের খাড়াই ঢালের গায়ে একবার ধাক্কা খেল, ছিটকে উঠে আরো শ খানেক ফুট নিচে নেমে গেল। তারপর ঝনাৎ করে একগাদা টুকরো পাথরের ওপর পড়ে থেমে গেল।
মেজর শেষবারের মত চারদিকে তাকিয়ে কিনারায় এসে দাঁড়ালেন। পাথরের গায়ে বসানো লোহার এক-একটা খাজ খুব সাবধানে পার হতে লাগলেন। এবার হিমবাহের দিকে এগিয়ে গেলেন। তুষারের ওপর দিয়ে পা টেনে টেনে বরফের শুভ্র বিস্তারের ওপর পড়ে থাকা সেই কালো জিনিসটার কাছে গিয়ে পৌঁছালেন। মৃতদেহটার পাশে এসে দাঁড়ালেন। তারপর ওবাহসার-এর দেহটাকে হিঁচড়ে টেনে নিয়ে এসে সবচেয়ে কাছের গভীর একটা ফাটলের মধ্যে ফেলে দিলেন। তারপর একরাশ আলগা তুষার ফেলতে লাগলেন তার ওপর। এবার পাহাড়ের ঢাল বেয়ে বাক্সটার কাছে এসে পৌঁছালেন। পাহাড়ই তার কাজ সেরে রেখেছে, বাক্স খোলা। কাট্রিজ পেপারের মোড়কটা যখন খুললেন তখন কোন চাঞ্চল্য দেখা গেল না মেজরের মুখে। শুধু সূর্যের আলোয় দুটো বড় বড় থান ঝলসে দিল তার চোখ-মুখ। দুটোরই গায়ে একই চিহ্ন–ঈগল পাখির পায়ের নিচে বৃত্তের মধ্যে একটা স্বস্তিকা, আর ১৯৪৩ সাল খোদাই করা– রাইস ব্যাংকের ট্যাক্শালের ছাপ। বাক্সটা তিনি বন্ধ করে দিলেন। ওয়েবৃলি রিভলভারের সঙ্গে লাগানো দড়িটা একদিকের হাতলে বেঁধে দিলেন। তারপর ধীরে ধীরে নামতে লাগলেন পাহাড়ের গা বেয়ে; দড়ির টানে বাক্সটা এগোতে লাগল তার পিছু পিছু।
দুপুর রোদে স্মিথের মুখ একেবারে ঝলসে যাচ্ছে। হিমবাহের মুখ থেকে বেরিয়ে আসা জলধারার কাছে থামলেন। আকণ্ঠ পানি পান করে আবার পাহাড় ভাঙতে লাগলেন। আর মাঝে মাঝে লোহার বাক্সটা হঠাৎ পিছলে এসে গোড়ালিতে ধাক্কা মারছিল। পাহাড়ের তলায় পৌঁছে ফার গাছের নিচে বসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলেন। উঠে বুশ শার্টটা মাটিতে বিছালেন, বাক্স থেকে সোনার বাট দুটো বের করে মাঝবরাবর রাখলেন। তারপর শার্টের তলাকার দুটো কোণ কষে বাঁধলেন দুই হাতার গোড়ায়, পুটের কাছে। গর্ত খুড়ে খালি বাক্সটাকে মাটি চাপা দিলেন।