টিফেব্বানার হোটেলের দু বিছানার ঘরে বাড়তি বিছানাটা কেবল পাকার কাগজের বান্ডিলে ভরে গিয়েছিল। স্মিথ এক-আধটা কাগজ টেনে নিয়ে চোখ বোলাচ্ছিলেন, আর মন দিয়ে পড়ছিলেন শুধু সেগুলো, যেগুলোর ওপর লেখা ছিল KOMMANDOSACHE, HOECHT VERTRAULICH.
একরম কাগজে বেশির ভাগই উঁচুদরের কর্তা ব্যক্তিদের সম্বন্ধে গোপন খবরাখবর, মিত্রপক্ষের গোপন সঙ্কেতের মর্মোদ্ধারের বিবরণ আর রসদের গোপন ভাঁড়ারের হদিশ থাকত। প্রধানত এ সবের তল্লাশিই হল A বাহিনীর কাজ। তাই গভীর উত্তেজনা নিয়ে কাগজগুলোকে আলাদা আলাদা করে গুছিয়ে রাখতে লাগলেন স্মিথ। তারপর প্যাকেটের একেবারে তলা থেকে পাওয়া গেল লাল গালা দিয়ে সীলমোহর করা একটা খাম। তার ওপর লেখা ও চরম জরুরি পরিস্থিতি ছাড়া ভোলা হবে না। খামের মধ্যে একটিমাত্র কাগজ। সবচেয়ে ওপরে লেখা। VAULTA, তলায় WILDEKAISER. FRANZISKANER HALT. 100M. OESTLICHSTEINHUGEL. WAFFNKISTE. ZWEIBAR 24 KT. এবং তার পর সেন্টিমিটারে কয়েকটা পরিমাপের তালিকা। বিস্ময়ে মেজর স্মিথের হাত দুটো আপনা থেকেই দু দিকে প্রসারিত হয়ে গেল। এক-একটা বাট দুটো করে থান ইটের সমান হবে। তিনি চটপট দেশলাই জেলে পুড়িয়ে দিলেন কাগজ আর খামটা। অস্ট্রিয়ান সামরিক ম্যাপটা মেলে ধরে এক লহমায় আঙুলের ডগাটা Franzisk aner Halt লেখার ওপর গিয়ে আটকে গেল। ধারাল দাঁতের মত খোঁচা খোঁচা কঠিন পাথরের এই বিকট পাহাড়টার জন্যই কিটজবুয়েল-এর উত্তর দিকের আকাশটা অমন ভয়ংকর দেখায়।
বন্ড ছোকরা যা বললে, শুরুটা ঠিক সেই রকমই হয়েছিল। ভোর চারটার সময় ওবাহসার-এর কুঠিতে গিয়েছিলেন মেজর স্মিথ। তাকে গ্রেফতার করেছিলেন। তার পরিবারের সবাই যখন কাঁদছিল, তাদের বলেছিলেন, ওকে মিউনিখ-এর একটা ক্যাম্পে নিয়ে যাচ্ছেন জিজ্ঞাসাবাদের জন্য। যদি ওর সম্বন্ধে সন্দেহজনক কিছু না পাওয়া যায় তবে এক সপ্তাহের মধ্যেই বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হবে। বাড়ির লোকজন যদি এখন এই নিয়ে হৈ-চৈ করে, ওবাহসার এর পক্ষে সেটা ভাল হবে না। মেজর নিজের নাম জানাননি। বুদ্ধি করে আগে থেকে জীপ গাড়ির নম্বরটাও অস্পষ্ট করে রেখেছিলেন। জানতেন যে, আর চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই A বাহিনী অভিযানে বেরিয়ে পড়বে, আর কিটজবুয়েল এ সামরিক সরকারের পতন হতে হতে দখল নেওয়ার তালেগোলে আজকের এই ঘটনাটা চাপা পড়ে যাবে।
প্রথম আতঙ্কটা কাটিয়ে ওঠার পর ওবাহসার আর কোনও বেগ দেয়নি। আলাপে-সালাপে দুজনের বেশ বন্ধুত্ব। হয়ে গিয়েছিল। কাইজার পাহাড়ের ধার ঘেঁষে কুফস্টেন পর্যন্ত যেতে হল। আস্তে আস্তে জীপ চালাতে চালাতে তখন পাহাড়ের চূড়াগুলোর খুব তারিফ করছিলেন স্মিথ। শেষ পর্যন্ত সেই বিশেষ পর্বতশিখরের তলা বরাবর পৌঁছে গাড়ি থামালেন। এক টুকরো ফাঁকা জমি দেখে গাড়ি রাখলেন, মনে মনে চূড়াটার নাম রাখলেন স্বর্ণ শিখর। এক সময় ওবাহসারকে বলে বসলেন যে, তোমাকে আমার বড় মনে ধরেছে। দুজনের শখ প্রায় একই ধরনের। আর কথাবার্তা থেকে তোমাকে যে ধরনের মানুষ বলে মনে হয় তাতে বোধ হচ্ছে নিশ্চয়ই তুমি নাৎসিদের সঙ্গে হাত মেলাওনি। আমি কি করব–বলি শোন, সারাদিন আমরা কাইজার পাহাড়ে চড়ব। তারপর গাড়ি করে তোমাকে কিটজবুয়েল-এ ফিরিয়ে নিয়ে গিয়ে আমার কমান্ডিং অফিসারকে বলব যে, মিউনিখ-এ তোমাকে নেড়েচেড়ে সন্দেহজনক কিছু পাওয়া যায়নি।
কৃতজ্ঞতায় লোকটি প্রায় কেঁদে ফেলে। কিন্তু এমন একটা দলিল পেতে হবে যাতে প্রমাণ থাকবে ও ভালমানুষ। শুধু মেজর স্মিথের সই থাকলেই হল। চুক্তি হয়ে গেলে জীপটাকে রাস্তা থেকে আড়াল করে পাইনের গন্ধ-ভরা উঁচু নিচু পাহাড়ি ঢাল পার হয়ে ওপরে উঠতে লাগলেন দুজনে।
স্মিথ-এর সঙ্গে ছিল ঐ ওয়েবৃলি অ্যান্ড স্কট বন্দুকটা। ওবাহসার, ভেবেচিন্তেই স্মিথকে বন্দুকটা পাথর-টাথরের খাজে কোথাও রেখে আসার পরামর্শ দেয়নি। মেজর স্মিথকে এ আশ্বাসও দিয়েছে যে, পাহাড় ভাঙতে দড়ি বা খোটার দরকার হবে না। তাছাড়া ঠিক ওপরেই একটা কুটির মত আছে, দরকার হলে সেখানে বিশ্রামও নেওয়া যেতে পারে। ওটাকে বলে ফ্রামজিমক্যানার হল্ট। তার ঠিক নিচে দিয়ে বয়ে যাচ্ছে একটা ছোট্ট হিমবাহ। তবে আমরা উঠব ওটাকে পাশ কাটিয়ে।
মেজর স্মিথ ওবারহসার-এর মাথার পিছন দিকটা লক্ষ্য করে দেখলেন ঘাড়ের কাছে বিন্দু বিন্দু ঘাম ফুটেছে।
স্মিথ-এর মাথায় শুধু চিন্তা কি করে আসলে মালটা পাহাড় বেয়ে নামান যাবে। ঠিক করলেন, দড়ি দিয়ে সোনার বাটগুলো পিঠে বেঁধে নেবেন।
গাছগাছালির এলাকা পার হয়ে যখন আরো উপরে উঠলেন, তখন সূর্য উঠে গেছে। বেশ গরম। এবার কেবল বড় বড় পাথর আর নুড়ি। আরো খাড়াই ঢাল বেয়ে বেশ খানিকটা ওঠার পর সেই নির্দিষ্ট চুড়ার কাছাকাছি এসে পড়লেন। তেষ্টা মেটাবার জন্য আর হাত-পা মুছে ঠাণ্ডা হবার জন্য খরস্রোতা একটা ছোট্ট পাহাড়ি ঝরনার কাছে যখন থামলেন, সেই অবসরে মেজর স্মিথের তাকত সম্পর্কে কিছুটা সুখ্যাতি শুনিয়ে দিলেন ওবারহসার। মেজরের মন তখন অন্য চিন্তায় মগ্ন। পাথরের গা বেয়ে ওঠা খুব-একটা শক্ত হল না। ওবারহসার যখন হাত বাড়িয়ে মাঝে মাঝে পাথর আঁকড়ে তার জোর পরখ করে দেখে নিচ্ছিল তখন একবার একটা চাঙড় হঠাৎ খসে এসে বিকট শব্দ তুলে নিচে গড়িয়ে পড়ল। শব্দটা কানে যেতেই একটা সম্ভাবনার আশঙ্কায় চমকে উঠলেন স্মিথ।