যতদূর জানি, আপনি তখন ছিলেন দুনম্বর কর্তা। কমান্ডিং অফিসার ছিলেন একজন আমেরিকান, কর্নেল কিং, প্যাটন-এর বাহিনীর লোক। ওর রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, প্রাথমিক পরীক্ষার জন্য সমস্ত কাগজপত্রই আপনার হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল। কারণ দলের মধ্যে আপনিই একমাত্র জার্মান জানতেন। পরে আপনি কি নিজের মন্তব্য লিখে সব কাগজই ফেরত দিয়েছিলেন তাকে?
ইঙ্গিতটা গায়ে না মেখে মেজর বললেন, বেশির ভাগই নামের তালিকা। কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স মানে প্রতিপক্ষের গুপ্তচরবৃত্তি ঠ্যাকাবার পক্ষে, খবরগুলো দরকারি। স্যাজবার্গ-এর কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স বিভাগের ওরা তো মহাখুশি। আমার মনে হয়, মূল দলিলগুলো কোথাও রাখা আছে হয়ত। ন্যুরেমবার্গের বিচারে কাজে লাগানো হয়ে থাকতে পারে। পুরানো কথা মনে করে স্মৃতির অতলে তলিয়ে যেতে চাইলেন মেজর স্মিথ।
জীবনের মধুরতম কয়েকটা মাস কেটেছে আমার এস ও বি-র সঙ্গে কাজ করে। সারা দেশের নানান জায়গায় সেই ছোটাছুটি করে বেড়ানো! মদ, মেয়েমানুষ আর গান-বাজনা!
মেজর স্মিথ সত্যই ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত বড় বিপজ্জনক আর অস্বস্তিকর যুদ্ধের কাজে কাটিয়েছিলেন। ১৯৪১ সালে যখন কম্যান্ডো বাহিনী তৈরি হয়। তখন তিনি স্বেচ্ছায় তাতে নাম লেখান। তারপর তিনি বদলি হয়ে যান রয়্যাল মেরিনস থেকে মাউন্টব্যাটেন-এর অধীনে কম্বাইন্ড অপারেশনস হেড কোয়ার্টারে। তিনি চমৎকার জার্মান জানতেন বলে। তাঁকে একটি কাজ দেওয়া হয় ইংলিশ চ্যানেলের ওপারে যেখানে যত কম্যান্ডো অভিযান চালান হবে, সেখানকার যুদ্ধবন্দিদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের বা জেরা করার কাজ। ভাগ্য সুপ্রসন্ন, তাই বছর দুয়েক কাজ করার পর অক্ষত দেহে ছাড়া পান এবং O B E (মিলিটারি) উপাধি অর্জন করেন।
যখন মিসলেনিয়াস অবজেটিভ ব্যুরো গঠন করা হল, তখন মেজর স্মিথকে সাময়িকভাবে লেফটেন্যান্ট-কর্নেল করে দেওয়া হল। তার ওপর ভার দেওয়া হল জার্মানির পতনের সময়ে গেস্টাপো আর অন্যান্য গুপ্ত কর্মীদের লুকানো ঘাঁটিগুলো ঝেটিয়ে সাফ করার জন্য একটি দল গড়ে তোলার। 0s s-এর নির্দেশে ছ টি ইউনিট বা দল গড়তে হল। এক-একটি ইউনিটে বিশজন কর্মী, ছ টি জীপ, বেতার ব্যবস্থাযুক্ত একটি ট্রাক এবং তিনটা লরি। এই হেড কোয়ার্টারের মাধ্যমে সন্ধান সূত্রের খবর পাওয়া যেত। A বাহিনীর দু নম্বর কর্তা হলেন মেজর স্মিথ। এই বাহিনীর হাতে যে এলাকার ভার দেওয়া হল, তার নাম টিরল–গা ঢাকা দেবার মত জায়গা বিস্তর আছে। ইউরোপের সীমানা পার হয়ে অন্য দেশের মধ্যে ঢুকে পড়ার সুযোগও খুব বেশি। MOB-এর লোকেরা যাদের সন্ধান করছে, জানা যায়, তারা নাকি এই জায়গাটা গোপন আস্তানা হিসেবে সবচেয়ে দুর্ভেদ্য বলে মনে করত। অথচ মেজর স্মিথ-এর কথা অনুযায়ী বোঝা যাচ্ছে, খুব সহজেই ধরা পড়েছিল সবাই। গুলি-গোলার ধার দিয়েও যেতে হয়নি।
বন্ড প্রশ্ন করল, হ্যাঁন্স ওবার হসার নামটা কি চেনা লাগে?
এ কথা শুনে মেজর স্মৃতির ভাণ্ডার হাতড়াতে হাতড়াতে কেঁপে উঠলেন।
বন্ড বলে উঠল, একটু মনে করিয়ে দিই তাহলে। দেখে নেবার জন্য যেদিন আপনাকে কাগজপত্রগুলো দেওয়া হয়, ঠিক সেদিনই টিফেব্ৰানার হোটেলে আপনার থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল–আপনি কিটজবুয়েল-এর সেরা পাহাড়ী গাইডের সন্ধান চেয়েছিলেন। আপনাকে ওবার হসার-এর কথা বলা হলে পরের দিন আপনি কম্যান্ডিং অফিসারের কাছে একদিনের ছুটি চান, মঞ্জুরও হয়। পরের দিন ভোর থাকতে আপনি ওবাহসার-এর কুঠিতে গিয়ে তাকে গ্রেফতার করেন এবং তাকে নিয়ে জীপে চড়ে বেরিয়ে পড়েন। এবার মনে পড়েছে কিছু? এরকমই যে একটা কিছু ঘটবে, তারই সম্ভাবনা নিয়েই তো কাটিয়েছ বছরের পর বছর। অনিশ্চয়তায় মাথা দোলালেন মেজর, কই, না তো! মেজর স্মিথ বন্ডের হিমশীতল স্বচ্ছ চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে বললেন, দুঃখিত। সুরাহা করতে পারছি না।
বন্ড একটা নোটবুক দেখে বলে গেল, সেই সময়ে আপনার সঙ্গে ছিল সেনাবিভাগের বাঁধা ছকের একটা ওয়েবৃলি অ্যান্ড স্কট বন্দুক, ৪৫ ক্যালিবারের বন্দুকটার সিলিয়াল নম্বর হল ৮৯৬৭/৩৬২। হেড কোয়ার্টার থেকে সেদিন বন্দুকটা আপনাকে দেওয়া হয়, আর যেদিন আপনি ফেরত দেন, তার তারিখ আমার কাছে আছে। দু বারই আপনি সই করেছেন খাতায়।
মেজর স্মিথ-এর গলায় উন্মা প্রকাশ পেল, এসব জেনে কি লাভ হচ্ছে?
বন্ড খুব কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকাল। কি যেন ভেবে নিয়ে বলল, শুনুন, বলি, নিজের কথায় যদি পুরো ঘটনাটা মুখ ফুটে খুলে বলেন, তাহলে আপনারই ঝঞ্ঝাট কমবে।
আপনার পক্ষে মুশকিলের কথা হল, খুব সামান্য দু একটা খুঁটিনাটি ছাড়া আমাদের আর কিছুই অজানা নয়। আর একটা কথা, কিংসটন-এ ফু-দের দু ভাইয়ের সঙ্গেও গতকাল কথা বলেছি। মিনিট দশেকের জন্য আমি বাগানে গিয়ে বসছি, আপনি ভেবে দেখার সময় পাবেন। সময় হলে আমাকে ডাক দেবেন। বাগানে বেরিয়ে গেল জেমস বন্ড।
এক ঝটকায় উঠে দাঁড়ালেন মেজর স্মিথ, ব্রান্ডির বোতল হাতে নিয়ে ভাবতে লাগলেন, এই বন্ড লোকটা যদি ফুঁ দের কাছে গিয়ে থাকে, তাহলে নিশ্চয়ই তারা ঝুলি ঝেড়ে সব ফাস করে দিয়েছে। তিনি একটি সিগারেট ধরালেন। ঘড়িতে তখন সাড়ে এগারোটা। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে লোকটাকে বিদায় করতে হবে। চুপচাপ বসে বসে তিনি ভাবনাগুলোকে গুছিয়ে নিতে লাগলেন। ভাবলেন, যত তাড়াতাড়ি পারা যায় শেষ করে দেওয়াই ভাল।