পৃথিবীর দক্ষিণ গোলার্ধের সমুদ্রের অধিকাংশ জায়গাতেই স্কর্পিয়ন ফিশ দেখতে পাওয়া যায়। কোন কোন মাছ লম্বা বারো ইঞ্চি ও ওজনে পাউন্ড খানেক হয়। এদের সারা গায়ে ধূসর খয়েরি রঙের ছিটছিট দাগ গজালের মত মাথাটা যেমন হেঁড়ে তেমনই থ্যাবড়া। চোখগুলো লাল। এদের মোক্ষম অস্ত্র হল পিঠের মাঝখানের পাখনা। এই পাখনার প্রথম দিকের কয়েকটা কাঁটা যেন ইঞ্জেকশনের উঁচ। কোনও কিছুর ছোঁয়া লাগলেই বিষের থলি থেকে তা দিয়ে এমন বিষ গড়িয়ে আসে যে, যেমন তেমন জায়গায় সামান্য একটু আঁচড় লাগলেই একটা মানুষ বেমালুম মরে যেতে পারে। এরা হাঙরের চেয়েও মারাত্মক। প্রবালপ্রাচীরের কাছাকাছি যারা সাঁতার কাটতে নামে, তাদের পক্ষে সত্যিকারের বিপদ বলতে এই স্কর্পিয়ন ফিশ।
ঠিক এমনই এক স্কর্পিয়ন ফিশের সন্ধানে ধনুক-ভাঙা পণ করে বেরিয়েছেন মেজর স্মিথ। সন্ধান করে তাকে কাঁচের ডগায় গাঁথবেন। তারপর তাঁর অক্টোপাসটাকে দিয়ে দেখবেন যে, কি করে। সমুদ্রের ডাকসাইটে একটা প্রাণীভুক রাক্ষস অন্য একটা মাছকে মারাত্মক বলে চিনতে পারে কিনা। তার বিষের কথা জানে কিনা। প্রফেসর বেঙ্গরি এসব প্রশ্নের উত্তর চান। আজ থেকেই মেজর স্মিথের এখানকার জীবনের শেষ অধ্যায়ের শুরু। তাই আজই প্রশ্নগুলোর উত্তর চাই। আর ইন্সটিটিউটের যেখানে সারি সারি সামুদ্রিক প্রাণীর নমুনা সাজানো আছে তারই ধূলিধূসর একটি কোণে তার সদ্য নিষ্ফল একটা স্মারক রেখে যেতে চান।
আসল ব্যাপার হল, মাত্র দু ঘণ্টা আগেই মেজর ডেক্সটার স্মিথের নিরাশ্বাস জীবনে দুর্ভাগ্যের ছায়াটা আরো ঘনিয়ে উঠেছে। আর কয়েক সপ্তাহের মাথায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের ওপর দিয়ে যদি রেহাই পান, তাহলে নিজেকে খুব সৌভাগ্যবান মনে করতে হবে। গভর্নমেন্ট হাউস থেকে ঔপনিবেশিক দপ্তরে টেলিগ্রাম যেতে, সেখান থেকে গুপ্ত বিভাগে, তারপর সেখান থেকে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড আর পাবলিক প্রসিকিউটারের হাতে নথিপত্র পৌঁছাতে সময় লাগবে খুবই সামান্য।
এসব কিছুর মূলে যিনি আছেন তার নাম হল কম্যান্ডার জেমস্ বন্ড। কিংস্টন থেকে সেদিনই লোকটা সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ এসে হাজির হয়েছে।
সকাল থেকে সবকিছুই স্মিথ স্বাভাবিকভাবেই করে যাচ্ছিলেন। সাড়ে দশটা বাজতে-না-বাজতেই যখন তিনি দ্বিতীয় দফার সকালের নাস্তা সারছেন এমন সময় বাড়ির চত্বরে গাড়ি ঢোকার শব্দ কানে এল। স্থানীয় বাসিন্দা লুনা এসে জানাল যে, এক ভদ্রলোক দেখা করতে চায়। নাম বলেনি। শুধু জানাতে বলেছে যে, গভর্নমেন্ট হাউস থেকে আসছে। স্মিথ বললেন, ঠিক আছে লুনা, ওনাকে বসবার ঘরে নিয়ে গিয়ে বসাও।
কিছুক্ষণ পরে ঘরে ঢুকেই তিনি দেখতে পেলেন নীল রঙের সুতির স্যুট পরা লম্বা একটা লোক বাইরে সমুদ্রের দিকে চেয়ে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে রয়েছে। দেখা মাত্রই মেজর স্মিথের মনে হল, খবর ভাল নয়। যখন লোকটার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসা সত্ত্বেও তার ঠোঁট দুটো একটুও ফাঁক হল না, তখন টের পেলেন যে, তাঁর শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেল। ওরা শেষ পর্যন্ত জেনে ফেলেছে তাহলে।
এই যে, আমি হলাম স্মিথ। শুনলাম, গভর্নমেন্ট হাউস থেকে আসছেন। স্যার কেনেথ কেমন আছেন? লোকটি বলল, আমার সঙ্গে দেখা হয়নি। আমার নাম বন্ড, জেমস্ বন্ড। প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের লোক। কোথাও বসে একটু কথা বলতে চাই।
বিলক্ষণ। যেখানে আপনার ইচ্ছা। জানালার মেহগনি কাঠের চ্যাটাল গোবরাটের ওপর অন্যমনস্ক হয়েই যেন দাঁড়াল লোকটা।
প্ল্যান্টারস্ চেয়ারের নিচু হাতলের ওপর একটা পা তুলে দিয়ে বসলেন মেজর স্মিথ। সোজা চোখে চোখ রেখে লোকটার দিকে তাকিয়ে বললেন, বলুন, আপনার জন্য কি করতে পারি? নর্থ শোর-এ কেউ উৎপাত বাঁধাচ্ছে নাকি? সাহায্যের জন্য লোক চাই? নতুন করে কাজের ভার নিতে খারাপ লাগবে না। কম দিন তো হল না, তবু কাজের নিয়ম-কানুনগুলো এখনো মনে আছে কিছু কিছু।
জেমস বন্ড বলল, না, এখানকার ব্যাপার কিছু নয়। আমাকে আসলে পাঠানো হয়েছে এই কথা বলতে যে, কয়েকটা ব্যাপার আপনাকে মনে করে আমাদের জানাতে হবে যুদ্ধের পরে আপনাকে যে কাজ দেওয়া হয়েছিল, সেই ব্যাপারে। মিসলেনিয়াস অবজেটিভস্ ব্যুরোর হয়ে যখন কাজ করতেন, বিশেষ করে সেই সময়কার কথা।
মেজর স্মিথ হেসে উঠলেন। অনাগত কিন্তু আসন্ন ভবিষ্যণ্টাকে দেখতে পেলেন। সেই পুরোনো দিনের এস ও বি! আমাদের অনেকেই এখন আর বেঁচে নেই বোধহয়।
আপনি জানেন হয়ত, ওয়ার বুক-এর ফোর্স-সংক্রান্ত অধ্যায়ের বেশির ভাগটা আমিই লিখেছিলাম। সে অনেক দিন হয়ে গেল। এতদিন পর কিছু কি আর বলতে পারব?
টিরল-এর কাজকর্ম সম্পর্কেও নয়? কিট্জবুয়েল-এর মাইলখানেক পূর্বে ওবের আউরাখ বলে জায়গার সেই ব্যাপারটা সম্পর্কে?
মেজর স্মিথ এই নামটা সারাজীবন মনে মনে বয়ে বেড়াচ্ছেন। তিনি হেসে বললেন, আরে সাহেব, সে এক লণ্ডভণ্ড ব্যাপার। গেস্টাপোর দল মদে চুর হয়ে আছে। কাগজপত্তরের ফাইলগুলো এক কথায় আমাদের হাতে তুলে দিল। আমরাও তাই ওদের ওপর জোর জুলুম করলাম না। মোটামুটি দেখে মিউনিখ ক্যাম্পে চালান দিলাম। এর পরের কথা। আমার আর কিছু কানে আসেনি। স্যালজবার্গ-এর সদর দপ্তরে ফাইলের বান্ডিল পাঠিয়ে দিয়ে আমরা চলে গেলাম মিটেরশিল উপত্যকায়, ওদের আর একটা লুকানো আস্তানার খোঁজে। এই হল মোটামুটি ব্যাপার।