- বইয়ের নামঃ জেমস বন্ড সমগ্র
- লেখকের নামঃ ইয়ান ফ্লেমিং
- প্রকাশনাঃ বিশ্বসাহিত্য ভবন
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, গোয়েন্দা কাহিনী, রহস্য
জেমস বন্ড সমগ্র
অক্টোপুসি
মেজর ডেক্সটার স্মিথ মুখোশের মধ্যে থেকে অক্টোপাসটাকে শুনিয়ে শুনিয়ে মুখ ফুটেই বললেন, কি জানিস? সুবিধা : করতে পারলে, আজ তোকে একটা জবর ভোজ দেব। মুখোশের কাঁচটা ঝাপসা হয়ে গিয়েছিল। সেটাকে পানিতে চুবিয়ে পরিষ্কার করে নিলেন। রবারের পট্টিটা মাথার ওপর দিয়ে আবার গলিয়ে দিলেন। হেঁট হয়ে ফের মাথা ডোবালেন পানির তলায়। প্রবাল স্কুপের গহ্বরের মধ্যে থেকে ছিটছিট খয়েরি রঙের থলথলে দেহপিণ্ডের ওপরকার জ্বলজ্বলে চোখের দৃষ্টি আগের মতই মেজরের দিকেই নিবদ্ধ। তবে তার ছোট্ট একটা শুড়ের ডগা এখন গর্তের অন্ধকারের বাইরে ইঞ্চি দুয়েক এগিয়ে এসে দুলতে শুরু করেছে। আর রক্ত চোষবার ফুলো ফুলো চাকতি লাগানো দিকটা ওপর দিকে ফিরিয়ে কিসের যেন সন্ধান করতে চেষ্টা করছে। মেজরের মুখে পরিতোষের হাসি। গত দু মাস ধরে তিনি চেষ্টা করছেন অক্টোপাসটার সঙ্গে ভাব জমাতে। মনে হয় আর মাসখানেকের মধ্যেই পোষ মেনে যাবে। কিন্তু সে এক মাস সময় আর পাওয়া যাচ্ছে না। তাহলে, আজকে একবার পরখ করে দেখবেন নাকি? একবার নিজের হাতটা বাড়িয়ে ধরে দেখবেন নাকি কি হয়?
স্মিথ মনে মনে ভাবলেন, না–এখন নয়। কখনোই পুরোপুরি বিশ্বাস করা চলে না। হয়ত আরো কয়েকটা গুঁড় তাহলে নির্ঘাৎ গর্ত থেকে সোজা বেরিয়ে এসে তার হাত জড়িয়ে ধরবে। তারপর পানির নিচে টেনে নামিয়ে আনবে। এর ফলে হয়ত ডুবে মরতে হবে। একটু বেশি ঝুঁকি নিয়ে হয়ত ঝঞ্ঝাটের হাত থেকে রেহাই পাওয়া যাবে। কিন্তু এখন নয়। কারণ সেই প্রশ্নটার সমাধান করা হয়ে ওঠে না তাহলে কৌতূহলটা মেটে না। ইন্সটিটিউটের প্রফেসর বেরি বড় চমৎকার লোক, তাকে কথা দেওয়া হয়ে গেছে যে।
ধীরে ধীরে তিনি সাঁতার কাটতে লাগলেন। তার সন্ধানী চোখ একটিমাত্র জিনিসকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। স্কর্পিয়ন ফিশ এর পিঠের ওপরকার একটা পাখনা চ্যাপ্টা গজালের মত কঠিন, ভয়ংকর। স্কর্পিয়ন ফিশ বেসূরি বলেন, স্কর্পিনা প্রমিয়েরি।
বুদ্ধিমান অফিসার এবং সুদর্শন পুরুষ মেজর ডেক্সটা স্মিথ, ও বি ই, রয়্যাল মেরিস, জীবনের বহু পরিচ্ছেদ পার হয়ে আজ পরিশিষ্টে এসে পৌঁছেছেন। সামরিক জীবনে বরাবরই নারী সম্ভোগ ছিল তাঁর কাছে অনায়াসসাধ্য। যুদ্ধের চাকরি শেষ হবার পর যে বিশেষ কর্মী সংগঠনে তাঁকে নিযুক্ত করা হয়। তার যোগাযোগ এবং করনিক বিভাগের উইমেন্স রয়্যাল ন্যাভাল সার্ভিস এবং উইমেন্স রয়্যাল আর্মি কোর-এর মেয়েদের ক্ষেত্রে তো কখনোই হার মানতে হয়নি। এখন তাঁর বয়স চুয়ান্ন। মাথায় সামান্য টাক পড়েছে। সাঁতারের ট্যাঙ্কটা পেটের ওপর চেপে বসে গেছে। তাছাড়া দু বার থ্রম্বসিসও হয়ে গেছে। কিন্তু এখন বাছা বাছা পোশাক পরে যখন ককটেল পার্টি বা ডিনারের মজলিশে যান তখন বেশ সুঠাম চেহারার মানুষ বলে মনে হয়।
আসল ব্যাপার হল, ডেক্সটার স্মিথকে এখন মরণদশায় পেয়ে বসেছে। তার মানসিক অবস্থার কারণ একাধিক। বাইরে থেকে শক্ত খুঁটির মত দেখতে হলেও অতীতের একটা দুষ্কর্মের পাপবোধ আর নিজের প্রতি বীতরাগ উইয়ের মত কুরে-কুরে ভেতরটাকে ফোপরা করে ফেলেছে। জ্যামাইকার সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়ে গেছেন তিনি। দু বছর আগে মেরি মারা যাওয়ার পর আর কাউকে ভালবাসতে পারেননি। মেরির প্রতি কতখানি ভালবাসা ছিল বলা কঠিন তবে প্রতিটি মুহূর্তে মেরির ভালবাসার অভাবটুকু টের পেতে হয়। নিঃসঙ্গ লাগে।
এদিকে আবার জ্যামাইকার নর্থ শোর অঞ্চলের বিভিন্ন জাতের লোকদের আড্ডায় খাবার বা মদ খেতে আপত্তি করেন না যদিও, মনে মনে ঘেন্নাই করেন ওদের, মিশতে পারেন না। বৃত্তিজীবী কিছু মানুষ বা রাজনীতিকদের সঙ্গে হয়ত বেছে বেছে বন্ধুত্ব করা চলত, কিন্তু তাতে আবার নতুন করে জীবনে একটা সত্যিকারের উদ্দেশ্য খাড়া হয়ে ওঠে–মানসিক অবসাদ, আর উদাসীন নিস্পৃহতা তাতে বাধা দেয়, মন তাতে সাড়া দেয় না।
মেজর স্মিথের জীবনটা একঘেয়ে হয়ে উঠেছে। নিজের জীবনটাকে হয়ত শেষ করে দিতেন কিন্তু জীবনের একটা দিক আছে তাঁর, যার জন্য পারেননি। জীবনের পাড় থেকে মৃত্যুর গহ্বরের দিকে যে সুতোটুকুকে অবলম্বন করে। এখনো ঝুলে থাকতে পারছেন মেজর স্মিথ, সেটা বড় পালা।
মেজর স্মিথ হলেন এক ধরনের পাগল। তার পাঁচ একর জমি ঘেরা তরঙ্গিনী ভিলার বাগানে বা সমুদ্রের পাড়ে কিংবা তীরের কাছাকাছি প্রবালপ্রাচীরের বাসিন্দা যত পাখি, পোকা-মাকড় আর জলজ প্রাণীদের নিয়ে নিজেকে ঘিরে একটা মোহময় স্বপ্নরাজ্য গড়ে তুলেছেন তিনি। মাছদের ওপরই তার আকর্ষণটা বেশি। মাছদের তিনি বলেন, লোকজন। তিনি ওদের প্রেমে পড়ে গেছেন আর তারাও তাকে ভালবাসে।
মাছরা মেজর স্মিথকে খুব ভালভাবেই চেনে। কারণ তিনিই ওদের খাবারের যোগান দিয়ে আসছেন। এখন এই যে তিনি এই সরু নালার মত জায়গাটা দিয়ে গভীর পানির দিকে, তাঁর প্রিয় মাছরা সব নির্ভয়ে তার চারপাশে আঁক বেঁধে ঘুরে বেড়াচ্ছে। রঙবাহারী এসব আত্মীয়-স্বজনদের দিকে মেজর স্মিথ আজ পুরো মনটা দিতে পারছেন না। কারণ আজ একটা কাজ সারতে হবে। চেতনার বেশির ভাগটাই জাগ্রত রেখেছেন চোখের তারায়। বিশেষ একজনের সন্ধান চাই, চোখে পড়া মাত্রই মেরে ফেলতে হাত কাঁপে না, সেটা হল স্কর্পিয়ন ফিশ।