তার তিন বছর পর গত হলেন তুর্গেনেফ।
এবারেও হয়তো তিনি কোনও সাহিত্যিক বন্ধুকে চিঠি লিখে সান্ত্বনা খুঁজেছিলেন। তখনকার দিনের ফ্রান্সের সব বিখ্যাত সাহিত্যিকদের সঙ্গেই তুর্গেনেফ, ফ্লবের, মপাসাঁর বন্ধুত্ব ছিল। ভিক্তর হু(য়ু)গো, এদমোঁ দ গঁকুর, এমিল জোলা, আলফঁস দদে এঁদের কাউকে হয়তো তিনি লিখেছিলেন, কিন্তু আমার মনে হয়, ফ্লবের গত হলে শোক নিবেদন করা যায় তুর্গেনেফকে, কিন্তু তুর্গেনেফ গত হলে লেখা যায় আর কাকে? বঙ্কিমের মৃত্যুসংবাদ রবীন্দ্রনাথকে জানিয়ে হয়তো সান্ত্বনার বাণী চাওয়া যায়, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ গত হলে বাঙালি জানাবে কাকে?
মপাসাঁ এর অনেক আগেই ফ্রান্সের বিখ্যাত পত্রিকায় তুর্গেনেফ সম্বন্ধে প্রশস্তি লিখেছিলেন। এবারে তিনি যেটি লিখলেন, সেটি বড়ই করুণ। মপাসাঁর পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থাবলিতে এ-দুটি থাকার কথা কিন্তু আজ যখন মপাসাঁকেই লোকে স্বীকার করতে চায় না– যদি-বা করে তা-ও তাঁর তথাকথিত অশ্লীল গল্পের জন্য– তখন তাঁর প্রবন্ধ পড়তে যাবে কে? তবু বলি আনাতোল ফ্রাঁসের রম্যরচনাকে যদি সত্য ও সুন্দরের অভূতপূর্ব অনির্বচনীয় সঙ্গম বলে ধরা হয়, তবে সে-দুটির উৎস খুঁজতে হবে মপাসাঁর রচনায়। তাঁর ছোটগল্পের সর্বত্র পরিচিত শৈলীতেই সেগুলো লেখা। ছোট ছোট শব্দ, ছোট ছোট বাক্য আর তার মাঝে মাঝে অকস্মাৎ দীর্ঘায়তন দীর্ঘকলেবর উদ্দাম উত্তাল শৈলধারার মতো দ্রুতগামী বাক্যবিন্যাস। মন্দাক্রান্তার পাঁচটা হস্বের পর দুটো দীর্ঘ এলে যে রসের সৃষ্টি হয়।
এর অনুবাদ করা আমার পক্ষে অসম্ভব। সারাংশ নিবেদন করি।
‘রুশ দেশের মহান ঔপন্যাসিক ইভান তুর্গেনেফ ফ্রান্সকে আপন দেশ-রূপে বরণ করেছিলেন। এক মাস অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করার পর তিনি গত হয়েছেন।
‘এ-যুগের অত্যাশ্চর্য লেখকদের তিনি অন্যতম। সঙ্গে সঙ্গে সাধু, সৎ, অকপট ও বন্ধুবৎসল সমাজের তিনি ছিলেন সর্বাগ্রণী! এরকম লোকের দেখা মেলে না।
তাঁর বিনয় ছিল আত্মাবমাননার কাছাকাছি; কাগজে তাঁর সম্বন্ধে কেউ কিছু লিখলে তিনি তা একেবারেই বরদাস্ত করতে পারতেন না। একাধিকবার তাঁর সম্বন্ধে উচ্চপ্রশস্তি সংবলিত রচনা তাঁকে যেন মর্মাহত করেছে; কারণ তিনি কিছুতেই স্বীকার করতে রাজি হতেন না যে, শুদ্ধ সাহিত্য ভিন্ন অন্য কোনও বিষয় নিয়ে রচনা লেখা হোক। সাহিত্য কিংবা কলা-সমালোচনাকে পর্যন্ত তিনি প্রগল্ভ বাক্যবিন্যাস বলে মনে করতেন। একবার কোনও এক সাহিত্য-সমালোচক তাঁর একখানা বই সম্বন্ধে আলোচনা করতে গিয়ে তাঁর জীবন নিয়ে কিঞ্চিৎ আলোচনা করাতে তিনি রীতিমতো আহত হয়েছিলেন। তাঁর সে বেদনা-বোধে ছিল লেখকের ব্রীড়া– শুদ্ধ বিনয় তার কাছে নতমস্তক হয়।
‘আজ গত হয়েছেন এই মহান পুরুষ; তাঁর সম্বন্ধে সামান্য কিছু নিবেদন করি।
‘প্রথমবার তাকে দেখি গুস্তাফ ফ্লবেরের পার্টিতে।
দরজা খুলতে ঘরে ঢুকলেন দৈত্য বিশেষ। রুপালি মাথা–রূপকথায় যাকে বলে রজতশির। লম্বা-লম্বা সাদা চুল, রুপালি চোখের পলক আর বিরাট সাদা দাড়ি–সত্যই যেন খাঁটি রুপোর অতি মিহিন তার দিয়ে তৈরি। ঝকঝক চকচক করছে, প্রতিটি রশ্মিকণা যেন তার উপর থেকে ঠিকরে পড়ছে। আর সেই ধবলিমার মাঝখানে শান্ত সুন্দর মুখচ্ছবি। নাক-চোখ যেন একটু বড় বেশি ধারালো। সত্যই যেন বরুণদেবের শির–চতুর্দিকে ধবল জলের ঢেউ তুলেছেন কিংবা আরও ভালো হয় যদি বলি, অনন্তদেব, বিশ্বপিতার মুখচ্ছবি।
‘অতি দীর্ঘ দেহ– বিরাট, কিন্তু দেহে মেদচিহ্ন নেই। আর সেই বিশালবপু, অতিকায় পুরুষটির চলাফেরা নড়াচড়া একেবারে শিশুটির মতো– বড় ভীরু-ভীরু ভাব। অতি মিষ্ট মৃদু কণ্ঠে কথা বলেন, কেমন যেন মনে হয়, পুরু জিভ শব্দের ভার যেন সইতে পারছে না। কখনও কখনও কথা বলতে বলতে, একটু আটকে যান, যেন ঠিক মনের মতো কথাটি ফরাসিতে কী হবে সেটা খোঁজেন আর প্রতিবারেই চমৎকার ঠিক শব্দটি খুঁজে পান। এই সামান্য থমকে যাওয়াটা তার বাচনভঙ্গিতে লাবণ্য এনে দিত।
‘গল্প বলতে পারতেন অতুলনীয় মধুর ভঙ্গিতে। সামান্যতম ঘটনাকে তিনি সেই ভঙ্গির পরশ লাগিয়ে রসের স্তরে তুলে নিতে পারতেন। তাঁর অসাধারণ প্রতিভার মূল্য আমরা ভালো করেই জানতুম কিন্তু আসলে তিনি সর্বজনপ্রিয় ছিলেন অন্য কারণে। তাঁর চরিত্রে শিশুর মতো সরলতা ছিল সম্পূর্ণ অবিশ্বাস্য; একদিক দিয়ে এই প্রতিভাবান ঔপন্যাসিক পৃথিবী পরিক্রমা করেছেন, তার যুগের তাবৎ গুণী-জ্ঞানীকে তিনি চিনতেন, মানুষের পক্ষে যা পড়া সম্ভব তার সবকিছুই তার পড়া ছিল, ইয়োরোপের সব ভাষা আপন মাতৃভাষার মতো বলতে পারতেন অথচ অন্যদিক দিয়ে তার আর পাঁচজন বন্ধুবান্ধবের কাছে যা-কিছু অতিশয় সামান্য সাধারণ তারই সামনে তিনি স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে অবাক মানতেন, ভাবতেন এটা হল কী করে?
‘সাহিত্য বিচারের সময় তিনি আমাদের পাঁচজনের মতো সবকিছু বিশেষ গণ্ডির ভিতর আবদ্ধ হয়ে বিশেষ দৃষ্টিবিন্দু থেকে দেখতেন না। পৃথিবীর তাবৎ সাহিত্য তাঁর খুব ভালো করে পড়া ছিল বলে সর্বসাহিত্যের সমন্বয় করে তারই বিরাট পটভূমিতে তিনি পৃথিবীর একপ্রান্তে প্রকাশিত একখানা বই তুলনা করতেন অন্যপ্রান্তে প্রকাশিত অন্য ভাষায় লিখিত আরেকখানা বইয়ের সঙ্গে। তাই তার সমালোচনা আমাদের কাছে তার বিশেষ মূল্য পেত।