এর কয়েক বছর পূর্বে এক বিদগ্ধ বিদূষক চিড়িয়াখানার শিম্পাঞ্জির ‘আঁকা’ একখানি ‘ছবি’ ওইরকম এক চিত্রপ্রদর্শনীতে পাঠিয়ে শহরের লোককে বোকা বানিয়েছিল– তখনও কেউ ধরতে পারেননি, ওটা বাঁদরের মশকরা।
কিন্তু প্রশ্ন, এই ধরনের তামাশা চলবে কতদিন ধরে? এই যে স্পন্টানিস্টের দল, কিংবা অন্য যে কোনও নামই এদের হোক– এরা আর কতদিন ধরে আপন ব্যবহার দিয়ে ইচ্ছায় প্রকাশ করবেন যে এদের আর্ট কোনওকিছু সৃজন করার দুরূহ শক্তিসাধনায় আয়ত্ত নয়, আকস্মিক দৈবদুর্বিপাকে বা অ্যাকসিডেন্ট বা ঘটনাকে এঁদেরই মতো উত্তম উত্তম ছবি আঁকতে পারে, শ্রেষ্ঠ গান গাইতে পারে, সার্থক কবিতা রচনা করতে পারে– এতদিন যা শুধু সরস্বতীর বরপুত্রেরাই বহু সাধনার পর করতে পারতেন?
এই প্রশ্নটি শুধিয়েছেন এক সরলচিত্ত, দিশেহারা সাধারণ লোক– সুইডেনের কাগজে।
উত্তরে আমরা বলি, কেন হবে না? এক কোটি বাঁদরকে যদি এক কোটি পিয়ানোর পাশে বসিয়ে দেওয়া হয়, এবং তারা যদি এক কোটি বংশপরম্পরা ওগুলোর ওপর পিড়িং পাড়াং করে তবে কি একদিন একবারের তরেও একটি মনোমোহন রাগিণী বাজানো হয়ে যাবে না? সে-ও তো অ্যাকসিডেন্ট।
আমার ব্যক্তিগত কোনও টীকা বা টিপ্পনী নেই। মডার্ন কবিতা পড়ে আমি বুঝি না, রস পাই না। সে নিয়ে আমার কোনও খেদ নেই। পৃথিবীতে যে অতশত ভালো জিনিস রয়েছে যার রসাস্বাদন আমি এখনও করে উঠতে পারিনি, ওগুলো আমার না হলেও চলবে।
ইভান সের্গেভিচ তুর্গেনেফ
গত ৩ সেপ্টেম্বর ইভান তুর্গেনেফের ৭৫তম মৃত্যুবার্ষিকী উদযাপিত হয়েছে। এ-উপলক্ষে বহু দেশ তাঁর স্মৃতির উদ্দেশে আপন আপন সশ্রদ্ধ প্রণাম জানিয়েছেন। কলকাতা বেতার কেন্দ্র পর্যন্ত সেদিন তাঁকে স্মরণ করেছেন।
প্রশ্ন উঠতে পারে, আজ এঁর, কাল ওঁর কত লোকের মৃত্যুবার্ষিকী, জন্মবার্ষিকী নিত্য নিত্য হয়ে যাচ্ছে, সেগুলোর হিসাব রাখতে যাবে কে?
যার যেরকম খুশি, এর বেশি কিছু বলা যায় না।
তাই জানি, আমরা যখন গোরস্তানে যাই, তখন খুঁজি আপন প্রিয় ও পরিচিতজনের কবর। যখন কোনও নতুন লাইব্রেরিতে ঢুকি তখন খুঁজি আপন প্রিয় লেখকের বই। তাই তুর্গেনেফের শতবার্ষিকী না হয়ে ৭৫তম মৃত্যুদিনও আমার ও আমার মতো বয়স্কদের মনে দোলা লাগিয়েছে। তরুণরা লাইব্রেরিতে যেরকম নতুন বইয়ের সন্ধান নেয়, ক্ল্যাসিস্ পড়ে না, ঠিক তেমনি তারা তুর্গেনেফ কিংবা হাইনের শতাব্দীপ্রয়াণও স্মরণ করে না; তারা স্মরণ করে ব্লাবো কবে হেঁচেছিলেন, ভেরেন কবে কেশেছিলেন।
তা তারা করুক। কিন্তু যখন দেখি অপেক্ষাকৃত বয়স্ক এবং তথাকথিত শিক্ষিত লোকও সদম্ভে বলে বেড়াচ্ছেন রাবোর কাছে রবিঠাকুর শিশু, মাইকেলের অমিত্রাক্ষর উডেন (কাষ্ঠরস) এবং সম্পাদকমণ্ডলীও সেগুলো পরম শ্রদ্ধাভরে ছাপাচ্ছেন তখন এঁরা যে তুর্গেনেফকে স্মরণ করবেন না সে তো জানা কথা। শুধু তাই নয়, এখন আপনার কাছে আমার পক্ষে তুর্গেনেফ কিংবা সত্যেন দত্তকে স্মরণ করতে হলে লন্ডনে রঙিন হওয়ার মতো রীতিমতো সঙ্কট-সঙ্কুল রাষ্ট্রভাষায় যাকে বলে খতরনাক– স্কন্ধোপরি যুগ্ম-শিরের প্রয়োজন!
আমি মুসলমান। আমার শাস্ত্রে আছে বিধর্মীর ভয়ে আল্লা-রসুলকে বর্জন করা মহাপাপ। আমার সাহিত্যধর্মে শুরু-মুর্শিদ হয়ে আছেন রবিঠাকুর, হাইনে, তুর্গেনেফ, মাইকেল। আজ এঁদের অস্বীকার করতে পারব না—র্যাঁবো-এলিয়ট সম্প্রদায় যতই শক্তিশালী হন না কেন।
এবং আমার মনের গোপন কোণে একটা অহেতুক ক্ষীণ আশা আছে যে তুর্গেনেফ-প্রীতিতে আমি একেবারে একা নই। ‘বুড়ো রাজা প্রতাপ রায়ে’র মতো বরজলালের হাত ধরে আমাকে একাকী সভাস্থল ত্যাগ করতে হবে না। প্রতাপ রায়ের সমকালীন শ্রোতা সে-সভাতে আর কেউ ছিল না। আমার কিন্তু এখনও অনেক মুরুব্বি আছেন। তাঁরা তুর্গেনেফ সম্বন্ধে আমার চেয়ে ঢের ভালো লিখতে পারেন, কিন্তু লেখেন না, কারণ তারা জানেন, পাগলাগারদে সুস্থ লোকের লক্ষণ দেখানো পাগলামি, ভেক যেখানে রব ছেড়েছে সেখানে কোকিলের পক্ষে মৌনতাই শ্রেয়– ‘ভদ্রং কৃতং কৃতং মৌনং কোকিল জলদাগমে।’
তুর্গেনেফের মন্দভাগ্য সম্বন্ধে তিনি নিজেই সচেতন ছিলেন। তিনি থাকতেন বিদেশে– জার্মানি এবং ফ্রান্সে– এবং সেখানে বসে বসেই তিনি জানতে পেতেন কীভাবে ক্রমে ক্রমে তিনি দসতেফস্কি তলস্তয় এমনকি কবি নেক্রাসফেরও বিরাগভাজন হয়েছেন। ‘বিরাগভাজন’ বললে বোধ করি কমই বলা হয়। তুর্গেনেফ শেষের দিকে রীতিমতো এঁদের বিদ্বেষভাজন হয়েছিলেন।
বিদ্বেষ আসে হিংসা থেকে। এঁদের সবাই বড় লেখক। জীবিতাবস্থায়ই এঁরা দেশে প্রচুরতম সম্মান পেয়েছিলেন। তবে দূর-দেশবাসী প্রবাসী নিরীহ (‘নিরীহ’ কেন সেকথা পরে হবে) তুর্গেনেফ তাঁদের ক্রোধের কারণ হয়েছিলেন কেন?
এ তত্ত্বটি বুঝতে পারলেই জানা যাবে লেখক হিসেবে তুর্গেনেফের অপ্রতিদ্বন্দ্বী মাহাত্ম্য কোনখানে?
দসতেফস্কি ও তলস্তয় জানতেন সৃষ্টির ক্ষেত্রে এঁদের আপন মাহাত্ম কোনখানে। দসতেফস্কি তাঁর প্রতি চরিত্রের গভীরতম অন্তস্তলে পৌঁছে গিয়ে তার সুখদুঃখ, তার দুর্বলতা মহত্ত্ব, তার প্রচেষ্টা এবং ভাগ্যে দ্বন্দ্ব, সমাজপ্রবাহের খরস্রোতের বিরুদ্ধে তার উজান চলার আপ্রাণপ্রয়াস, কিংবা সে-স্রোতে গা ঢেলে দিয়ে ভেসে যেতে যেতে তাকে প্রাণভরে অভিসম্পাত– এ সবকিছু লোহার কলম দিয়ে পাথরের উপর খোদাই করতে পারেন, ভাস্করের মতো দৃঢ়পেশি সবল হস্তে। প্রত্যেকটি চরিত্র তাঁর হাতে যেন দৈত্যের হাতে প্রজাপতি। চোখে এরে, বুকে অসীম করুণা। তার লেখা পড়ে মনে হয়, একটা বিরাট এঞ্জিন আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে। খেলার এঞ্জিন যত তেজেই এগিয়ে আসুক না কেন, জানি, ভালো করেই জানি, সামান্য কড়ে আঙুলটি তার সামনে ধরলেই সে থেমে যাবে, কিন্তু দসতেফস্কির এঞ্জিন পিঁপড়ের গতিতে এলেও তার সামনে যা পড়বে তার আর উদ্ধার নেই। অরসিকতম পাঠকেরও সাধ্য নেই, তার বর্ণনা পড়ে তিনি যা বলতে চেয়েছেন, তা না শুনে বা বুঝে থাকতে পারে! কিংবা বলব, কুমির যেরকম ছাগলের বাচ্চার ঠ্যাং কামড়ে ধরে ডুব দেয় নদীতে, দসতেফস্কি সেরকম পাঠককে নিয়ে ডুব দেন মানবচরিত্রের অতল সায়রে। এবং আশ্চর্য, সেখানে মণি-মুক্তার সঙ্গে সঙ্গে যে ক্লেদ-পঙ্ক দেখি তার প্রতিও তো ঘৃণা হয় না। মাতাল বাপের উচ্ছলতায় সরলা কুমারী রাস্তার বেশ্যা হয়ে বাপকে মাতলামোর পয়সা যোগাচ্ছে–কই, লোকটাকে তো খুন করতে ইচ্ছে করে না। তার অসহায় অবস্থা দেখে শুধু ভগবানকে শোধাতে ইচ্ছে করে, ‘একে বিবেকহীন পাষণ্ডরূপে জন্ম দিলে না কেন? এরও তা হলে কোনও দুঃখ থাকত না, আমরাও অকরুণ হৃদয়ে তাকে খুন করতে পারতুম। কিন্তু এ সব বোঝে, এ তো সবকিছু জানে। তবে এই ঝঞ্ঝা-ঝড়ের ঘূর্ণিবায়ুর মাঝখানে মানুষকে তুমি প্রজাপতির মতো সৃষ্টি করলে কেন?’ কিংবা হয়তো অতখানি চিন্তা করার শক্তিই পাঠকের থাকে না। মোহ্যমান হয়ে যায় পাঠক সেই বিশ্বব্যাপী অভিজ্ঞতার সামনে– সমস্ত জীবন বয়ে বেড়ায় তার অনপসরণীয় স্মৃতি।