তাই হট্টগোল আরম্ভ হওয়ার পূর্বেই আমি নিবেদন করছি, এ প্রস্তাবটি শুধু তাদেরই জন্য, যারা বুঝে গিয়েছে যে সংস্কৃতে তারা বিদ্যাসাগর হতে পারবে না, ওটাকে নিতান্ত পরীক্ষা পাসের জন্য যেটুকু সম্মান দিতে হয় তাই দেবে, বাঙলা মাতৃভাষা, এবং ইংরেজির চর্চা ততটুকুই করবে যতটুকু পাসের পর চাকরির জন্য নিতান্তই প্রয়োজন। এই সংজ্ঞা থেকেই সুচতুর পাঠক বুঝে যাবেন যে, আমি মোটামুটি থার্ড ইয়ার ফোর্থ ইয়ার ছেলেদের কথাই ভাবছি। অর্থাৎ এরা ক্লাসে (সেভেন-এটে) যেরকম পড়ি-মরি হয়ে তিনটে ভাষার পিছনে ছুটত এখন আর তা করে না। বিশেষত গোটা পাঁচেক ইয়ার্লি আর খান-দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা পাস করে এরা ভাষা না শিখে কী করে তার পরীক্ষা পাস করতে হয় সে ‘বিদ্যায়’ বিলক্ষণ রপ্ত হয়ে গিয়েছে।
এতখানি বলার পরও যদি কেউ লেমনেডের বোতল খোঁজে তবে আমার দ্বিতীয় নিবেদন, গোটা দুই ভাষা শিখলে চাকরি জোটার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে। হল? এখন তবে আশা করতে পারি, পাঠক বোতলটি আমার মাথায় ফাটিয়ে সেটার ভিতরকার জিনিস বরফের সঙ্গে মিশিয়ে আমাকে খাওয়াবার চেষ্টা করবেন।
দয়া করে সেটিও করবেন না। কারণ আমি যে প্রস্তাব করতে যাচ্ছি সেটা লটারির টিকিট কাটার চেয়ে মাত্র এক চুল ভালো– এই যা। ইংরেজিতে একেই বলে ‘চেজিং দি ওয়াইল্ড গিজ’–কিন্তু চাকরির বাজারে বাঙালির ছেলের সামনে যখন কোনও ‘গুজ’ই নেই তখন আশা করিতে পারি সে ঘরের না খেয়ে বনের হাঁস তাড়া করতে আপত্তি করবে না। বুঝিয়ে বলি।
স্বাধীনতা লাভের পূর্বে ভাষা শেখার কোনও অর্থকরী মূল্য এদেশের ছিল না। স্বরাজ লাভের পর অবস্থাটা বদলেছে। আমরা নানা দেশে আমাদের রাজপ্রতিনিধি, রাজদূত, হাইকমিশনার, কন্সাল-জেনারেল, কন্সল, ট্রেড-কমিশনার এবং তাদের দতরের জন্য কাউনসেলর, প্রথম-দ্বিতীয়-তৃতীয় সেক্রেটারি, মিলিটারি আতাশে, ট্রেড আতাশে, প্রেস আতাশে, কেরানি, দোভাষী ইত্যাদি পাঠাচ্ছি এবং দিল্লির পরদেশি দফতর বা ফরেন অফিসেও ভাষা জাননে-ওলা লোকের প্রয়োজন হয়। তাছাড়া বেতার-কেন্দ্র ফরাসি, ইরানি, ফারসি, কাবুল-ফারসি, আরবি, পশতু, সুহেলি, গুর্খালি, বর্মি, ইন্দোনেশি ও চীনা ভাষায়-ও প্রোগ্রাম দেন। আমাদের ফৌজি স্কুলেও অনেক ভাষা শেখানো হয়।
এই তিনটি প্রতিষ্ঠানে যে গণ্ডায় গণ্ডায় চাকরি খালি পড়েছে তা নয়, তবু আমার ব্যক্তিগত ধারণা উপযুক্ত ভাষাজ্ঞান থাকলে যোগ্য লোককে এ তিনটি প্রতিষ্ঠান খাতির করবে। আর পূর্বেই নিবেদন করেছি, আমার এ প্রস্তাব তাদেরই জন্য, যারা চাকরির বাজারে একটুখানি রিস্ক, রতিভর ঝুঁকি নিতে রাজি আছে।
আমি যে খবরটি দিলুম সেটি কিছুমাত্র নতুন নয়। কারণ প্রায়ই বেকার ছেলেরা এসে আমাকে অনুরোধ জানায় তাদের ফ্রেঞ্চ-জর্মন শিখিয়ে দিতে। (এখানেই লক্ষ করে রাখুন। ‘ফ্রেজ-জর্মনই’ বলে, অন্য কোনও ভাষার নাম তোলে না) আমার সময়ের অভাব, দ্বিতীয়ত আমি বাঙালিটাই ভালো করে জানিনে– কাজেই ফরাসি-জর্মনের কথাই ওঠে না, তাই তাদের কিঞ্চিৎ সদুপদেশ দিয়ে বিদেয় দিই।
এদের প্রশ্ন করে দেখলুম, এরা জানে না (ক) কোন ভাষার চাহিদা বাজারে কতখানি, (খ) কোন ভাষা শক্ত আর কোনটা নরম, (গ) ভাষা শিখতে হয় কী করে এবং আরও অনেক কিছুই জানে না।
আমি দোষ দিচ্ছিনে। জানবার সুযোগ দিলে তো তারা জানবে। আর যদি জানতই তবে আজ আমি এ বিষয়ে লিখতে যাব কেন?
আমাকে এক উত্তম ব্যবসায়ী বলেছিল, ‘জিনিস বেচা সোজা, কেনা শক্ত।’ আমি তো তাজ্জব। বলে কী? তখন বুঝিয়ে বলল, ‘বাজারে ঠিক যে জিনিসের চাহিদা তাই দিয়ে যদি আমি আমার দোকান সাজিয়ে রাখি তবে সন্ধে হতে না-হতেই দোকান সাফ হয়ে যাবে। তাই বললুম, বেচা সহজ। কিন্তু আড়তদারদের কাছ থেকে যদি বে-আক্কেলের মতো বে-চাহিদার মাল কিনি তবে সেগুলো দোকানে পচবে, দোকান উঠে যাওয়ার পরও। তাই বললুম, “কেনা শক্ত”।’
এস্থলেও সেই নীতি প্রযোজ্য। অর্থাৎ প্রথম দেখতে হবে, আপনি কী মাল কিনবেন, অর্থাৎ কোন ভাষা শিখবেন।
সবাই বলে ‘ফেঞ্চ-জর্মন’। এ যেন কথার কথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফ্রেঞ্চ ভুবনবিখ্যাত ভাষা। এককালে ফ্রেঞ্চ না জেনে কূটনীতি মহলে যাওয়া বিনা পৈতেয় ব্রাহ্মণভোজে যাওয়ার মতো ছিল। এখনও পৃথিবীর যেকোনো দেশের পাসপোর্টে দেখতে পাবেন দুটি ভাষাতে সবকিছু ছাপা, প্রথমটি তার আপন ভাষা এবং দ্বিতীয়টি ফরাসি। কিন্তু এসব হচ্ছে উনবিংশ শতকের কথা। আপনি যদি সেই শতকের চাহিদা মেটাতে চান, তবে মেটান। আপনি যদি এক শ বছরের পুরনো বিজ্ঞাপন মাফিক চাকরির জন্য দরখাস্ত চান তো করুন।
তাই প্রথম দেখতে হবে : এখন, এই মুহূর্তে চাহিদা কী এবং চাহিদার গতিটি কোন দিকে, অর্থাৎ আপনি ভাষাটা শিখে দু তিন বছরে যখন বাজারে নামবেন তখন চাহিদাটা কী হবে?
ভাষার প্রাধান্য তার লোকসংখ্যা থেকে বিচার করা ভুল। দৃষ্টান্তস্বরূপ চীনা ভাষা নিন। ইংরেজি, রাশান, চীনা এ তিন ভাষায় কথা বলে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি লোক একথা সত্য, কিন্তু চীনা ভাষায় লোক-সংখ্যা যত বেশিই হোক না কেন, তারা সবাই মাত্র একটি রাষ্ট্রের অধিবাসী! কাজেই ওই রাষ্ট্রে আমাদের থাকবে মাত্র একটি এম্বেসি। পক্ষান্তরে জর্মন ভাষার অবস্থা বিবেচনা করুন। জর্মন বলা হয় জর্মন রাষ্ট্রে (উপস্থিত সেটিও আবার দুই রাষ্ট্রে বিভক্ত), অস্ট্রিয়া রাষ্ট্রে এবং সুইজারল্যান্ডে। এই তিন দেশে আমাদের তিনটি রাজদূতাবাস আছে। তাছাড়া জর্মন বলা হয়, উত্তর ইটালির টিরোল, ফ্রান্সের আলসেস লরেন ও বেলজিয়ামের অয়পেন অঞ্চলে। এসব অঞ্চলে যদি কখনও রাজনৈতিক গোলমাল আরম্ভ হয়। এবং আপনাকে তার রিপোর্ট লিখতে সেখানে যেতে হয় তবে জর্মন ছাড়া এক পা-ও এগুতে পারবেন না। এবং সর্বশেষ কথা : জর্মনি, অস্ট্রিয়া, সুইজারল্যান্ড বেচে তৈরি মাল, ভারত বিক্রি করে কাঁচা মাল। এসব দেশের সঙ্গে আমাদের ব্যবসা দ্রুতগতিতে বাড়তেই থাকবে; বিস্তর কনসুলেট ও ট্রেড-কমিশন ক্রমে ক্রমে ওসব জায়গায় আমাদের খুলতে হবে।(১) কিন্তু চীন ও ভারত সমগোত্রীয়, দু জনেই বেচে কাঁচামাল, অতএব ‘বৈবাহিক’ বৈষয়িক কাজ আমাদের চলে না।