৩. শ্রীরামকৃষ্ণের প্রিয় কথার আড়।
৪. দারা তাঁর অতুলনীয় ধর্মগ্রস্থ আরম্ভ করেছেন এই বলে : ‘হে প্রভু, তুমি তোমার সুন্দর মুখ কুফর (অবিদ্যা) কিংবা ইমান (বিদ্যা) দু পাশের কোনো অলকগুচ্ছ (জুলুফ) দিয়ে ঢেকে রাখনি’। এই শ্লোক ঈশোপনিষদের ‘অন্ধং তমঃ প্রবিশন্তি যেহ বিদ্যামুপাসতে। ততো ভূয় ইব তে তমো ষ উ বিদ্যায়াং রতাঃ ॥’-রই অনুবাদ
৫. বস্তুত, সম্পূর্ণ নতুন ধর্ম পৃথিবীতে কোনো মহাপুরুষ কখনোই আরম্ভ করেননি। বুদ্ধদেব বলতেন, তাঁর পূর্বে বহু বুদ্ধ জন্ম নিয়েছেন, মহাবীর জৈনদের সর্বশেষ তীর্থঙ্কর বা জিন। খ্রিস্ট বলেন, তিনি বিধির বিধান ভাঙতে আসেননি– তিনি এসেছেন তাকে পূর্ণরূপ দান করতে। হজরত মুহম্মদ বলতেন, তার পূর্বে সহস্র পয়গম্বর আবির্ভূত হয়েছেন। বস্তুত এঁদের কেউ বলেননি, আমি প্রথম। প্রায় সকলেই বরঞ্চ বলেছেন, আমিই শেষ।
৬. একটা অবিশ্বাস্য গল্প শুনেছি, কোনো ব্রাহ্ম ভক্ত নাকি কদম্বতরুকে ‘অশ্লীল বৃক্ষ’ নাম দিয়েছিলেন। কিন্তু এর থেকে অন্তত এইটুকু বোঝা যায়, হিন্দুরা ব্রাহ্মদের ‘গোঁড়ামি’ সম্বন্ধে তখনকার দিনে কী ধারণা পোষণ করতেন।
৭. রাজনীতির ক্ষেত্রে এই শিক্ষিত-অশিক্ষিতের ব্যবধানের জন্য আমরা যে কী কর্মফল ভোগ করেছি, সে তথ্যের উত্থাপন এস্থলে অবান্তর।
৮. আমাদের ব্যক্তিগত প্রার্থনা, তাই যেন হয়। বাউল গেয়েছেন, ‘যে জন ডুবল, সখী, তার কী আছে আর বাকি গো?’ ঠাকুরও প্রায়ই গাইতেন ‘ডোব ডোব, ডোব।’
৯. এক চীনা সাধক এরই কাছাকাছি এসে বলেছেন, ‘মাই কাপ ইজ স্মল; বাট আই ড্রিঙ্ক অফনার।’
১০. বিদ্যাসাগর মহাশয় এ দ্বন্দ্বের সমাধান না করতে পেরে দু রকম ভাষাই ব্যবহার করতেন। ‘সীতার বনবাসে’র ভাষা সকলেই চেনেন, কিন্তু যেখানে তিনি রামা-শ্যামাকে বিধবাবিবাহের শত্রুদের বিপক্ষে ক্ষেপাতে চেয়েছেন, সেখানে ‘কস্যচিৎ ভাই-পোষ্য’ এই বেনামিতে, ‘ফাজিল-চালাক’, ‘দিলদরিয়া তুখোড় ইয়ার’, ‘তার একটি বেদড়া মন্ত্রী আছে–এটি তারই ত্যাঁদড়ামি’, ‘লোকটা লক্ষ্মীছাড়া বক্কেশ্বর আনাড়ির চূড়ামণি বে অকুফের শিরোমণি’। ইত্যাদি গ্রাম্য বাক্য পরমানন্দে ব্যবহার করেছেন। তিনি যেসব আদিরসাত্মক গল্প ছাপায় (!) প্রকাশ করেছেন সেগুলো সমাজে বললে এখনো সমূহ বিপদের সম্ভাবনা।
১১. শক্তিকে নানা দেশের কবি এবং সাধকগণ নানারূপে কল্পনা করেছেন। কাব্যে বিবেকানন্দের কবিতাই শ্রেষ্ঠতম।
মৃত্যুরূপা মাতা
‘নিঃশেষে নিবিছে তারাদল, মেঘ এসে আবরিছে মেঘ,
স্পন্দিত, ধ্বনিত অন্ধকার, গরজিছে ঘূর্ণবায়ু-বেগ!
লক্ষ লক্ষ উন্মাদ পরান বহির্গত বন্দিশালা হতে,
মহাবৃক্ষ সমূলে উপাড়ি ফুঙ্কারে উড়ায়ে চলে পথে।
সমুদ্র সংগ্রামে দিল হানা, ওঠে ঢেউ গিরিচূড়া জিনি’
নভস্তল পরশিত চায়। ঘোররূপা হাসিছে দামিনী,
প্রকাশিছে দিকে দিকে তাঁর মৃত্যুর কালিমামাখা গায়
লক্ষ লক্ষ ছায়ার শরীর!– দুঃখরাশি জগতে ছড়ায়–
নাচে তারা উন্মাদ তাণ্ডবে; মৃত্যুরূপা মা আমার আয়।
করালী। করাল তোর নাম, মৃত্যু তো নিশ্বাসে-প্রশ্বাসে;
তোর ভীম চরণ-নিক্ষেপ প্রতি পদে ব্রহ্মাণ্ড বিনাশে
কালী, তুই প্রলয়রূপিণী, আয় মা গো, আয় মোর পাশে
সাহসে যে দুঃখ দৈন্য চায়– মৃত্যুরে যে বাঁধে বাহুপাশে
কালনৃত্য করে উপভোগ—-মাতৃরূপা তারি কাছে আসে’। (সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের অনুবাদ)
ইংরেজিতে এর প্রথম ছত্র ‘The Stars are blotted out!’– আশ্চর্য বোধহয় রবীন্দ্রনাথও অতি বাল্যবয়সে (১৪?) কালী সম্বন্ধে একটি কবিতা লিখেছিলেন।
১২. ডগমাটিজম না করে মনকে খোলা এবং জানা-অজানার মাঝখানেই যে সত্য পন্থা- এর উৎকৃষ্ট প্রকাশ কেনোপনিষদে :
‘নাহং মনন্য সুবেদেতি নো ন বেদেতি বেদ চ।
যো নস্তছেদ দে নো ন বেদেতি বেদ চ ॥’।
‘আমি এইরূপ মনে করি না যে, আমি ব্ৰহ্মকে উত্তমরূপে জানিয়াছি; অর্থাৎ “জানি না” ইহাও মনে করি না, এবং “জানি” ইহাও মনে করি না। ‘জানি না যে তাহাও নহে– এবং জানি যে তাহাও নহে’ আমাদের মধ্যে যিনি এই বচনটির মর্ম জানেন, তিনিই ব্রহ্মকে জানেন।’– গম্ভীরানন্দ।
১৩. পূর্ববর্তী যুগে পরাগল, ছুটি খাঁর মতো মুসলমান গুণগ্রাহী ছিলেন বলেই হিন্দুরা মহাভারত অনুবাদ করেছিলেন; পরবর্তী যুগে হিন্দু সমঝদার ছিলেন বলেই সৈয়দ মরতুজা প্রমুখ বহুতর মুসলমান বৈষ্ণব পদাবলী রচনা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। শ্রীযতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্যের বাংলা সাহিত্যে বৈষ্ণবভাবাপন্ন মুসলমান কবিগণ এ সম্বন্ধে অত্যুকৃষ্ট পুস্তিকা দ্রষ্টব্য।
১৪, এ বিষয়ে পরমহংসদেব কতখানি নাছোড়বান্দা ছিলেন তার সবচেয়ে ভালো উদাহরণ অনুসন্ধিৎসু পাঠক পাবেন, অনিল গুপ্ত সংস্করণ, চতুর্থ খণ্ডের চতুর্থ ভাগে। পাঠক তখন ‘নাছোড়বান্দা’র সত্যপ্রয়োগ সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ হবেন।
হরিনাথ দে’র স্মরণে
বহু ভাষা শিখতে পারলে বহু সাহিত্যের সঙ্গে পরিচয় হয়। তার মারফতে অনেক সভ্যতা, বিস্তর সংস্কৃতির সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপিত হয়– এসব কথা ছেলেবেলা থেকেই শুনে আসছি।
উপস্থিত দেখতে পাচ্ছি, বাঙালি ছেলেকে বাধ্য হয়ে অন্তত তিনটে ভাষা শিখতে হয়– বাঙলা, ইংরেজি এবং সংস্কৃত (কিংবা আরবি অথবা ফারসি)। হয়তো তাকে হিন্দিও শিখতে হচ্ছে, কিংবা অদূরভবিষ্যতে শিখতে হবে। এ অবস্থায় আমি যদি প্রস্তাব করি, আরও গুটি দুই শিখলে হয় না? তা হলে ছেলেদের হাতে আমার প্রাণ বিপন্ন হবার সমূহ সম্ভাবনা বাঙলা দেশে না থাকলেও এ খবরটি আমি বিলক্ষণ রাখি। বিশেষত এই পুজোর বাজারে– মানুষ যখন বলির পাঁঠার সন্ধানে থাকে।