ওদিকে যেসব ব্রাহ্ম ভক্তের অর্থাভাব ছিল না, যাঁরা ব্রহ্মজ্ঞানের তপস্বী তাঁদের বারবার বলেছেন, ঈশ্বরকে ব্যাকুল হয়ে ডাকো। কলিযুগে ভক্তি ভিন্ন গতি নেই।
আর সকলকেই একথা বলেছেন, এই জন্মেই যারা সাধনার সর্বশেষ স্তরে পৌঁছতে চায়– রাখাল, নরেন্দ্রের মতো যারা জন্মাবধি জীবন্মুক্ত তাদের কজন বাদ দিলে, আর কটি প্রাণী সে স্তরে পৌঁছতে পারবে সে বিষয়ে তাঁর মনে গভীর সন্দেহ ছিল– তাদের হতে হবে নিরঙ্কুশ জ্ঞানমার্গের সাধক। শুদ্ধ জ্ঞানের সাহায্যে হৃদয়ঙ্গম করতে হবে, ব্রহ্ম ভিন্ন নিত্যবস্তু কিছুই নেই।
পূর্বেই নিবেদন করেছি, শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবকে সমগ্রভাবে উপলব্ধি করার ক্ষমতা আমার নেই। একথা স্বীকার করেও যদি দম্ভভরে কিছু বলি, তবে বলব, যে সাধক গীতোক্ত কর্ম, জ্ঞান এবং ভক্তির সমন্বয় করতে পেরেছেন তিনি সমগ্র পুরুষ– পরম পুরুষ। কোনও মহাপুরুষকে যদি দম্ভভরে যাচাই করতে চাই, তবে এই তিনটির সমন্বয়েই সন্ধান করব। তার কারণ গীতাতে এই তিন পন্থা উল্লিখিত হওয়ার পর আজ পর্যন্ত অন্য কোনও চতুর্থ পন্থা আবিষ্কৃত হয়নি। এ তিন পন্থার সমন্বয়কারী শ্রীকৃষ্ণের সহচর। তাঁর নাম শ্রীরামকৃষ্ণ।
***
যে পাঠক ধৈর্য সহকারে আমার প্রগলভতা এতক্ষণ ধরে শুনলেন তিনি কৌতূহলবশত স্বতই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করবেন, ‘এ তো হল মানুষের সংসর্গে আগত সমাজে সমুজ্জ্বল রামকৃষ্ণদেব। কিন্তু যেখানে তিনি একা– তাঁর সাধনার লোকে তিনি কতখানি উঠতে পেরেছিলেন? সোজা বাংলায়, ‘তিনি কি ভগবানকে সাক্ষাৎ দেখতে পেয়েছিলেন?’
এর উত্তরে বলব, মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করি, এ প্রশ্নের উত্তর দেবার অধিকার আমাদের কারওরই নেই। এ প্রশ্নের উত্তর জ্ঞানবুদ্ধির অগম্য। রামকৃষ্ণের সমকক্ষজনই এর উত্তর দিতে পারেন।
রামকৃষ্ণদেব বলেছেন, ‘সাধনার সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছনোর পরও কোনও কোনও মানুষ লোকহিতার্থে সংসারে ফিরে আসেন। যেমন নারদ শুকদেবাদি।’ একথা ভুললে চলবে না।
স্পষ্টত দেখতে পাচ্ছি, একথাটি স্বামী বিবেকানন্দের মনে গভীর দাগ কেটে গিয়েছিল। লোকহিতার্থে তিনি যে বিরাট শ্রীরামকৃষ্ণ মিশন নির্মাণ করে যান, এরকম সঙ্ঘবদ্ধ প্রতিষ্ঠান প্রভু তথাগতের পর এযাবৎ কেউ নির্মাণ করেননি।
***
এইবারে শেষ প্রশ্ন দিয়ে প্রথম প্রশ্নে ফিরে যাই।
পরমহংসদেব গীতার তিন মার্গের সমন্বয় করেছিলেন। প্রকৃত হিন্দু সেই চেষ্টাই করবে। কিন্তু তিনি যে ধুতিখানাকে লুঙ্গির মতো পরে আল্লা-আল্লাও করেছিলেন এবং আপন ঘরে টাঙানো খ্রিস্টের ছবির দিকে তাকিয়ে থাকতেন সেকথাও তো জানি। এসবের প্রতি তাঁর অনুরাগ এল কোথা থেকে? বিশেষত যখন একাধিকবার বলা হয়েছে, অ-হিন্দু মার্গে চলবার সময় পরমহংসদেব কায়মনোবাক্যে সেই মার্গকেই বিশ্বাস করতেন।
অনেকের বিশ্বাস চতুর্বেদে বহু দেব-দেবীতে বিশ্বাস অর্থাৎ পলিথেইজমের বর্ণনা আছে। কিন্তু ম্যাক্সমুলার দেখিয়েছেন ঋগ্বেদের ঋষি যখন ইন্দ্রস্তুতি করেন তখন তিনি বলেন—‘হে ইন্দ্র, তুমিই ইন্দ্র, তুমিই অগ্নি, তুমিই বরুণ, তুমি প্রজাপতি, তুমিই সব।’
আবার যখন বরুণমন্ত্র শুনি, তখন সেটিতেও তাই– ‘হে বরুণ, তুমিই বরুণ, তুমিই ইন্দ্র, তুমিই প্রজাপতি, তুমিই সব।’ অর্থাৎ ঋষি যখন যে দেবতাকে স্মরণ করেছেন তখন তিনিই তার কাছে পরমেশ্বররূপে দেখা দিয়েছেন। এ সাধনা বহু-ঈশ্বরবাদের নয়। এর সন্ধান অন্য দেশে পাওয়া যায় না বলে ম্যাক্সমুলার এর নতুন নাম করেছিলেন, ‘হেনোথেয়িজম’।
পরমহংসদেব বেদোক্ত এই পন্থাই বরণ করেছিলেন অর্থাৎ সনাতন আর্য-ধর্মের প্রাচীনতম শ্রুতিসম্পন্ন পন্থা বরণ করেছিলেন। তিনি যখন বেদান্তবাদী তখন বেদান্তই সব কিছু, আবার যখন আল্লা আল্লা করেছেন তখন আল্লাই পরমাল্লা।
এই করেই তিনি সর্বধর্মের রসাস্বাদন করে সর্বধর্ম সমন্বয় করতে পেরেছিলেন।
কোনও বিশেষ শাস্ত্রকে সর্বশেষ, অভ্রান্ত, স্বয়ংসম্পূর্ণ শাস্ত্র বলে স্বীকার করে তিনি অন্য সবকিছুর অবহেলা করেননি।
অনেকের বিশ্বাস, হিন্দু আপন ধর্ম নিয়েই সন্তুষ্ট, অন্য ধর্মের সন্ধান সে করে না।
বহু শতাব্দীর বিজয়-অভিযান ঘাত-প্রতিঘাতের ফলে এযুগের হিন্দু সম্বন্ধে একথা হয়তো খাটে। তাই পরমহংসদেব আপন জীবন দিয়ে দেখিয়ে দিলেন, সনাতন আর্যধর্ম এ পন্থা কখনও গ্রাহ্য করেনি।
সত্য সর্বত্র বিরাজমান, ঋগ্বেদের এই বাণী, শ্রীরামকৃষ্ণে তারই প্রতিধ্বনি। সর্বত্র এর অনুসন্ধানে সচেতন থাকলে বাঙালি পরমহংসদেবের অনুকরণ অনুসরণ করে ধন্য হবে। বাকিটুকু দয়াময়ের হাতে।
————
১. বর্তমান লেখকের মনে সন্দেহ আছে, শাক্য মুনির আবির্ভাবের ঠিক পূর্বেই এই পরিস্থিতি হয়েছিল। বৈদিক ভাষা তখন প্রায় অবোধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল বলেই ক্রিয়াকর্ম-যাগযজ্ঞ-পশুহত্যা তখন সত্য-ধর্মের স্থান অধিকার করে বসেছিল। বুদ্ধদেব তখন এরই বিরুদ্ধে সত্যধর্ম প্রচার করেন ও সর্বজনবোধ্য লোকায়ত প্রাকৃত (পরে পালি নামে পরিচিত) ভাষার শরণ নেন।
২. শ্রীশ্রীপরমহংসদেবের গাওয়া গান এরই কাছাকাছি :
আপনাতে আপনি থেকো মন যেও নাকো কারু ঘরে
যা চাবি তা বসে পাবি, খোঁজ নিজ অন্তঃপুরে।
শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত, অনিল গুপ্ত সংস্করণ, ১ম খণ্ড, ২১৩ পৃ.।