জনগণপূজ্য শক্তির সাকার সাধনা (‘পৌত্তলিকতা’ শব্দটা সর্বা বর্জনীয় এটাতে তাচ্ছিল্য এবং ব্যঙ্গের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত আছে) স্বীকার করে পরমহংসদেব তৎকালীন ধর্মজগতের ভারসাম্য আনয়ন করলেন বটে কিন্তু প্রশ্ন, জড়সাধনার অন্ধকার দিকটা কি তিনি লক্ষ করলেন না?
এইখানেই তাঁর বিশেষত্ব এবং মহত্ত্ব। এই সাকার-সাধনার পশ্চাতে যে জ্ঞেয়-অজ্ঞেয় ব্রহ্মের বিরাট মূর্তি অহরহ বিরাজমান, পরমহংসদেব বারবার সেদিকে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। এই ভারসাম্যই ব্ৰহ্মজ্ঞানী কেশব সেন, বিজয়কৃষ্ণ এবং তাদের শিষ্যদের আকর্ষণ করতে পেরেছিল। তিনি যদি ‘মতুয়া’ কালীপূজক হতেন তবে তিনি পরমহংস হতেন না।
বস্তৃত একটি চরম সত্য আমাদের বারবার স্বীকার করা উচিত : যেইখানেই যেকোনো মানুষ যেকোনো পন্থায় ভগবানের সন্ধান করেছে তাকেই সম্মান জানাতে হয়। এমনকি ক্ষুদ্র শিশু যখন সরস্বতীর দিকে তাকিয়ে তার সাহায্য কামনা করে (হায়, কলকাতায় সরস্বতী পূজার বাহ্য আড়ম্বর দেখে অনেক সময় মনে হয়, এরাই বুঝি এ যুগে দেবীর একমাত্র সাধক) তাকেও মানতে হয়– গাছের পাতা, জলের ফোঁটা যখন মানুষ মাথায় ঠেকায় তার বিলক্ষণ মূল্য আছে। গীতাতে এ সত্যটি অতি সরল ভাষায় বলা হয়েছে।
কিন্তু সাকার-নিরাকার নিয়ে আজ আর তর্ক করে লাভ কী? বাঙলা দেশে আজ আর কজন লোক নিরাকার পূজা করেন তার খবর বলা শক্ত কারণ সে পূজা হয় গৃহকোণে, নির্জনে। আর কলকাতায় বারোয়ারি সাকার পূজার যা আড়ম্বর তা দেখে বাঙলার কত গুণীজ্ঞানী যে বিক্ষুব্ধ হন তার প্রকাশ খবরের কাগজে প্রতি বৎসর দেখি। এইমাত্র নিবেদন করেছি, এরও মূল্য আছে– তাই আমার এক জ্ঞানী বন্ধু বড় দুঃখে বলেছিলেন, কিন্তু কী ভয়ঙ্কর স্ট্রেন করে এস্থলে সে সত্যটি স্বীকার করি।’
সাকার-নিরাকারের আধ্যাত্মিক মূল্য যা আছে তা আছে, কিন্তু এই দ্বন্দ্ব সমাধানের সামাজিক মূল্য কী?
হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান, ব্রাহ্ম সকলেই বাঙালি সমাজে সমান অংশীদার। এঁদের ধর্মাচরণ যা-ই হোক না কেন, সমাজে তারা মেলামেশা করছেন অবাধে। একবার ভেবে দেখলেই বোঝা যাবে এই সহজ মেলামেশা না থাকলে খ্রিস্টান মাইকেল, মুসলমান মুশররফ হুসেন, নজরুল ইসলাম এবং জসীম উদ্দীন বাঙলা কাব্যে খ্যাতি অর্জন করতে পারতেন না। সমঝদার ও রসিক জনের গুণগ্রাহিতা ও উৎসাহ লাভ না করে কম কবিই এ সংসারে সার্থক কাব্য সৃষ্টি করতে পেরেছেন। এবং এঁদের সকলেরই উৎসাহী পাঠক এবং গুণগ্রাহী বন্ধু ছিলেন প্রধানত হিন্দুরাই।(১৩)
আধ্যাত্মিক, সামাজিক, রাজনৈতিক যেকোনো মতবৈষম্যের ফলে যদি ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায়। একই সমাজের ভিতর অন্তরঙ্গ ভাব বর্জন করেন তবে সেই অখণ্ড, সমগ্র সমাজের অপূরণীয় ক্ষতি—‘মহতী বিনষ্টি’ হয়; এই তত্ত্বটি সম্বন্ধে সে যুগে কয়জন গুণী সচেতন ছিলেন। মুসলমান সাকার মানে না, কিন্তু তাই বলে তো সে যুগে বাঙালি সমাজের হিন্দু-মুসলমানের মিলন ক্ষুণ্ণ হয়নি? তবে কেন ওই কারণেই ব্রাহ্মে-হিন্দুতে সামাজিক অন্তরঙ্গ গতিবিধি বন্ধ হবে?
পরমহংসদেব এই বিরোধ নির্মূল করতে চেয়েছিলেন বলেই সাকার-নিরাকারের অর্থহীন, অপ্রিয় আলোচনা বর্জন করেননি। তাই বারবার দেখি; তিনি আপন হিন্দু ভক্তবৃন্দ নিয়েই সন্তুষ্ট নন। বারবার দেখি, তিনি উদগ্রীব হয়ে জিগ্যেস করছেন, বিজয় কোথায়, শিবনাথ যে বলেছিল আসবে, বলছেন কেশব আমার বড় প্রিয়। অথচ তিনি তো ব্রাহ্ম ভক্তদের ‘কালীকাল্টে’ কনভার্ট করার জন্য কিছুমাত্র ব্যগ্র নন। তিনি সর্বান্তঃকরণে কামনা করেছিলেন, এদের বিরোধ যেন লোপ পায়।(১৪)
আমার ব্যক্তিগত দৃঢ় বিশ্বাস, এই দ্বন্দ্ব অপসারণে অদ্বিতীয় কৃতিত্ব পরমহংসদেবের।
সামাজিক দ্বন্দ সম্বন্ধে এতখানি সচেতন পুরুষ যে তার অর্থনৈতিক সমস্যা সম্বন্ধে সচেতন থাকবেন এ কখনওই হতে পারে না। পক্ষান্তরে, আবার অন্য সত্যও সর্বজন বিদিত– কামিনী-কাঞ্চনে পরমহংসের তীব্র বৈরাগ্য। তার থেকেই ধরে নিতে পারি, অর্থ সমস্যা আপন সত্তায় (Per se) তাঁর সামনে উপস্থিত হয়নি। যারা মুখ্যত অর্থ কামনা করে রামকৃষ্ণদেব তো তাদের উপদেষ্টা নন। যাঁরা মুখ্যত ধর্মজিজ্ঞাসু অথচ অর্থসমস্যায় কাতর তিনি তাদের সে দ্বন্দ্ব সম্বন্ধে সচেতন ছিলেন। কাজেই পরোক্ষভাবে তিনি সমাজের অর্থনৈতিক প্রশ্নেরও সমাধান দিয়েছেন। যে যতখানি কাজে লাগাতে পেরেছে ততখানি উপকার পেয়েছে।
রামকৃষ্ণদেব বহুবার বলেছেন, ‘কলিকালে মানবের অনুগত প্রাণ’। এর অর্থ আর কিছুই নয়– এর সরল অর্থ, ইংরেজের শোষণনীতির শোচনীয় পরিণাম বাঙালির মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় তখন হাড়ে হাড়ে বুঝতে পেরেছে। অন্নাভাবে সে তখন এমনই কাতর যে অন্য কোনও চিন্তার স্থান আর তার মস্তকে নেই। যাঁরা ধর্মে অনুরক্ত তারা বারবার পরমহংসদেবকে প্রশ্ন করেছেন, ‘উপায় কী?’
পূর্বেই বলেছি তিনি ছিলেন বেদান্তবাদী। তা হলে তাঁর কাছ থেকে উত্তর প্রত্যাশা করতে পারি যে, জগৎ মায়া-মিথ্যা অনুমিত হলেই অর্থের প্রয়োজন আপনার থেকেই ঘুচে যাবে। কিন্তু তিনি বলেছেন, পাখির মতো দাসীর মতো সংসারের কাজ করে যাবে, কিন্তু মন পড়ে রইবে ভগবানের পায়ের তলায়। অর্থাৎ কলিযুগে সমাজের সে সচ্ছলতা নেই যে তোমাকে অন্ন জোটাবে আর তুমি নিশ্চিন্ত মনে জ্ঞানমাগে আপন মুক্তির সন্ধান পাবে। কলির মানুষের কর্ম থেকে মুক্তি নেই।