ধর্মের যেসব বাহ্যানুষ্ঠান সত্যধর্ম থেকে অতি দূরে চলে গিয়ে অধর্মে রূপান্তরিত হয়েছে তার বিরুদ্ধে রাজা সংগ্রাম আরম্ভ করলেন সতীদাহের বিরুদ্ধে আন্দোলন আরম্ভ করে এবং সে সংগ্রামের জন্য তিনি অস্ত্রশস্ত্র সঞ্চয় করলেন হিন্দু স্মৃতি থেকেই। এস্থলে রাজা বিশ্বজনীন যুক্তিতর্ক ব্যবহার না করে প্রধানত ব্যবহার করলেন হিন্দুশাস্ত্রসম্মত ন্যায় এবং উদাহরণ। রাজা প্রমাণ করলেন যে তিনি দর্শনের যেরকম বিদগ্ধ, ক্রিয়াকর্মের ভূমিতেও অনুরূপ স্মার্ত মল্লবীর।
শাস্ত্রালোচনায় ঈষৎ অবান্তর হলেও এস্থলে বাংলা সাহিত্যানুরাগীর দৃষ্টি তার অতি প্রিয় একটি বস্তুর দিকে আকর্ষণ করি। রাজাকে তাঁর আন্দোলন চালাতে হয়েছিল কলকাতার বাঙালিদের ভিতর। এঁরা সংস্কৃত জানেন না। তাই তাকে বাধ্য হয়ে লিখতে হয়েছিল বাঙলা ভাষাতে। পদ্য এসব যুক্তি-তর্কের সম্পূর্ণ অনুপযুক্ত বাহন। তাই তাঁকে বাঙলা গদ্য নির্মাণ করে তার-ই মাধ্যমে আপন বক্তব্য প্রকাশ করতে হয়েছিল। রাজার পূর্বে-যে বাঙলা গদ্য লেখা হয়নি এসব বলা আমার উদ্দেশ্য নয়, কিন্তু হিন্দুধর্মের এই তুমুল আন্দোলন আকর্ষণ মন্থনের ফলে যে অমৃত বেরুল তারই নাম বাঙলা গদ্য। পৃথিবীর ইতিহাসে এ জাতীয় ঘটনা বহুবার ঘটেছে; তথাগতের কৃপায় পালি, মহাবীরের কৃপায় অর্ধমাগধী। হজরত মুহম্মদের কৃপায় আরবি গদ্য, লুথারের কৃপায় জর্মন গদ্যের সৃষ্টি। পূর্বেই নিবেদন করেছি, গণবোধ্য মাতৃভাষাতে শাস্ত্রালোচনা না থাকলে ক্রিয়াকর্মের আত্যন্তিক প্রসার পায়; তার বিরুদ্ধে নবধর্ম পত্তন কিংবা সনাতন ধর্মের সংস্কার আন্দোলন আরম্ভ হয়;(৫) এবং সে আন্দোলনকে বাধ্য হয়েই গণ-ভাষার আশ্রয় নিতে হয়।
রাজার প্রচলিত সংস্কার উপনিষদে আপনার দৃঢ়ভঙ্গি নির্মাণ করার ফলে কতকগুলো জিনিস সে অস্বীকার করল। তার প্রথম, সাকার উপাসনা। দ্বিতীয় বৈষ্ণবধর্মের তদানীন্তন প্রচলিত রূপ; ক্রমে ক্রমে গণ-ধর্মের (Folk religion) প্রতি ব্রাহ্মদের অবজ্ঞা স্পষ্টতর হতে লাগল।(৬) প্রমাণ স্বরূপ বলতে পারি, তখনকার দিনে কেন, আজও যদি কেউ ব্রাহ্মমন্দিরের বক্তৃতা দিনের পর দিন শোনে তবু সে উপনিষদের পরবর্তী যুগের ধর্ম-সাধনার অল্প ইঙ্গিতই শুনতে পাবে। তার মনে হবে, উপনিষদ-আশ্রিত ধর্মদর্শনের শেষ হয়ে যাওয়ার পর আজ পর্যন্ত হিন্দুরা আর কোনও প্রকারের উন্নতি করতে পারেননি। এমনকি গীতার উল্লেখও আমি অল্পই শুনেছি। রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণের কথা প্রায় কখনওই শুনিনি। বৃন্দাবনের রসরাজ-রসমতীর অভূতপূর্ব অলৌকিক প্রেমের কাহিনী থেকে কোনও ব্রাহ্ম কখনও কোনও দৃষ্টান্ত আহরণ করেননি।
ধর্ম জানেন, আমি ব্রাহ্মদের নিকট অকৃতজ্ঞ নই। পাছে তাঁরা ভুল বোঝেন তাই বাধ্য হয়ে ব্যক্তিগত কথা তুললুম এবং করজোড়ে নিবেদন করছি, আমি মুসলমান, আমার কাছে হিন্দু যা ব্রাহ্মও তা, আমি হিন্দু-ব্রাহ্ম উভয় পন্থার (আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস পন্থা ভিন্ন নয়) সাধু-সন্তদের বারবার নমস্কার করি।
ব্রাহ্মধর্মের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ যতই অধ্যয়ন করি ততই দেখতে পাই, ব্রাহ্মরা যেন ক্রমে ক্রমেই জনগণ থেকে দূরে সরে যাচ্ছিলেন। জনগণকে ব্রহ্মমন্ত্রে দীক্ষিত করে এক বিরাট গণ-আন্দোলন আরম্ভ করার প্রচেষ্টা যেন তাদের ভিতর ছিল না। এ যুগেও তার উদাহরণ পাইনি। ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে আজ পর্যন্ত আমি বহু ব্রাহ্ম পরিবারের আতিথ্য লাভ করেছি, ফলে গভীর হৃদ্যতা হয়েছে, কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনও ব্রাহ্ম পরিবারের হিন্দু চাকর-বাকরদের ব্রহ্মমন্ত্রে দীক্ষিত করার প্রচেষ্টা দেখিনি। মুসলমান-খ্রিস্টানরা সর্বদাই করে থাকেন বলেই এটা আমার কাছে আশ্চর্যজনক বলে মনে হয়েছিল। আমার মনে হয়, ব্ৰহ্মমন্ত্র সার্বজনীন কিন্তু একথাও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি ব্রহ্মজ্ঞানীরা যেকোনো কারণেই হোক সর্বজনকে আহ্বান জানাতে পারেননি। মুসলমানের সমাজে মুটে-মজুর চাকর-বাকরের সংখ্যাই বেশি, হিন্দুর সংকীর্তনে ভাবোল্লাসে নৃত্য করে নিম্ন শ্রেণির প্রচুর হিন্দু আর মন্দিরে আরতির সময় শিক্ষিত হিন্দুকে তো আজকাল দেখতেই পাওয়া যায় না। অথচ পূর্ববঙ্গের ব্রাহ্ম-সম্মেলনে ব্রাহ্ম চাকর-নফর দেখেছি বলে মনে পড়ে না।
তার জন্য আমি ব্ৰহ্মবাদীদের আদৌ ক্রটি ধরছি না। এঁরা অক্ষম ছিলেন, একথা আমি কখনও স্বীকার করব না। আমার মনে হয়, এঁরা প্রধানত সমাজের নেতৃস্থানীয়দের নিয়েই আপন আন্দোলন আরম্ভ করেছিলেন এবং তাদের মাধ্যমে যে আমাদের মতো বহু হিন্দু-মুসলমান প্রচুর উপকৃত হয়েছিলেন সে বিষয়েও কোনও সন্দেহ নেই।
কিন্তু এ বিষয়েও কোনও সন্দেহ নেই যে হিন্দু-ধর্মের গণরূপ তখন একেবারেই অভিভাবকহীন হয়ে পড়ল। তার জন্য ব্রাহ্মদের দোষ দিলে অত্যন্ত অন্যায় হবে; দোষ হিন্দুদের। তাদের নেতৃস্থানীয়েরা তখন হয় দীক্ষা নিয়েছেন কিংবা ব্রাহ্মদের প্রতি সহানুভূতিশীল, আপন গরিব জাত-ভাই কী ধর্মকর্ম করছে এবং তার কল্যাণে সত্যধর্মের সন্ধান পাচ্ছে কি না এ বিষয়ে তাঁরা তখন উদাসীন। যেন গণধর্ম নয়, যেন ধর্মে একমাত্র শিক্ষিতজনেরই শাস্রাধিকার।
অতিশয় মারাত্মক পরিস্থিতি। দেশের দশের তা হলে সর্বনাশ হয়। শিক্ষিতজনকেও শেষ পর্যন্ত তার তিক্ত ফল আস্বাদ করতে হয়।(৭)