কিন্তু বিপদ ঘটে, যখন ওই ক্রিয়াকর্মের যুগে হঠাৎ এক বিদেশি ধর্ম এসে উপস্থিত হয়, তার চিন্তাধারা তার সত্যপথ সন্ধানের আন্দোলন-আলোড়ন নিয়ে। এবং ওই ধর্মজিজ্ঞাসার সঙ্গে সঙ্গে যদি অন্যান্য রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক (কঁৎ, মিল ইত্যাদি) প্রশ্নের যুক্তিতর্কমূলক, আলোচনা-গবেষণা বিজড়িত থাকে তবে ক্রিয়াকর্মাসক্ত সমাজের পক্ষে সমূহ বিপদ উপস্থিত হয়। বাঙালি সমাজের অগ্রণীগণ ইংরেজের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে গিয়ে অনেকখানি ইংরেজি শিখে ফেলেছেন এবং খ্রিস্টধর্মের মূলতত্ত্ব, তার মহান আদর্শবাদ, সেই ধর্মে অনুপ্রাণিত মহাজনগণের সমাজসংস্কার প্রচেষ্টা তাঁদের মনকে বারবার বিক্ষুব্ধ করে তুলেছে তাদের মনে প্রশ্ন জেগেছে, আমাদের ধর্মে আছে কী, আছে তো শুধু দেখতে পাই অন্তঃসারশূন্য পূজা-পার্বণ, আর ওদের ধর্মে দেখি, স্বয়ং ভগবান পিতারূপে মানুষের হৃদয়দ্বারের কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন। তাঁকে পেলে এই অর্থহীন জীবনযাপন চরম মূল্য লাভ করে, দুঃখ-দৈন্য আশা-আকাঙ্ক্ষা এক পরম পরিসমাপ্তিতে অনন্ত জীবন লাভ করে।
হিন্দুশাস্ত্রের অতি সামান্য অংশও যাঁরা অধ্যয়ন করেছেন তাঁরাই জানেন, এসব কিছু নতুন তত্ত্ব নয়। বস্তুত জীবনসমস্যা ও ধর্মে তার সমাধান এই অবলম্বন করেই আমাদের সর্বশাস্ত্র গড়ে উঠেছে। একদিকে দৈনন্দিন জীবনের অন্তহীন প্রলোভন, অন্যদিকে সত্যনিষ্ঠার প্রতি ধর্মের কঠোর কঠিন আদেশ–এ দুয়ের মাঝখানে মানুষ কী প্রকারে সার্থক গৃহী হতে পারে, সেই পন্থাই তো আমাদের শাস্ত্রকারগণ যুগে যুগে দেখিয়ে গেছেন।
কিন্তু এসব তত্ত্ব যাঁরা জানতেন তারা থাকতেন গ্রামে, তাঁরা পড়তেন পড়াতেন টোল চতুম্পাঠীতে এবং তাঁরা ইংরেজের সংস্পর্শে আসেননি বলে ওদের ধর্ম যে নাগরিক হিন্দুকে নানা প্রশ্নে বিচলিত করে তুলেছে সে সংবাদ তাঁদের কানে এসে পৌঁছয়নি!
আর সবচেয়ে আশ্চর্য, এইসব ‘টোলো’ ‘বিটলে বামুন’-রা যে শুধু পাদ্রি সাহেবদের। সঙ্গে তর্কযুদ্ধে আপন ধর্মের মর্যাদা মহিমা অক্ষুণ্ণ রাখতে পারত তা নয়, তারা যে কান্ট-হেগেল-এর চেলাদের সঙ্গে বিশুদ্ধ দর্শনের ক্ষেত্রেও সংগ্রাম করতে প্রস্তুত ছিল এ তত্ত্বটিও নাগরিক হিন্দুদের সম্পূর্ণ অজানা ছিল। ‘ঘরের কাছে নিই নে খবর, খুঁজতে গেলাম দিল্লি শহর’ লালন ফকিরের অর্থহীন গীত নয়।(২) এঁরা সত্যই জানতেন না, আমাদের টোলে শুধু স্মার্ত নন, নৈয়ায়িকও ছিলেন, এবং স্মার্তরাও যে শুধু তৈলবট নিয়ে বিধান দিতেন তাই নয়, তারা সে বিধানের সামাজিক মূল্যও যুক্তিতর্ক দিয়ে প্রমাণ করতে পারতেন।
কলকাতায় চিন্তাশীল গুণীজন তখন এই পরিস্থিতি দেখে বিচলিত হয়েছিলেন।
সৌভাগ্যক্রমে এই সময় রাজা রামমোহন রায়ের উদয় হল। তাঁর ব্রাহ্ম-আন্দোলন যে বাঙালি জাতির কী পরিমাণ উপকার করেছে, এই ব্রাহ্মসমাজের কীর্তিমান পুরুষসিংহ রবীন্দ্রনাথ বাংলা সাহিত্যকে যে কী পরিমাণ ঐশ্বর্যশালী ও বহুমুখী করে গিয়েছেন, তার সম্পূর্ণ হিসাব-নিকাশ এখনও শেষ হয়নি। বাঙালি সাধক, বাঙালি লেখক, বাঙালি পাঠক সকলেই সেকথা স্বীকার করেছেন। স্বয়ং শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব বলেছেন–
এদানির ব্রাহ্মধর্ম যায় ছড়াছড়ি
তাহারেও বারবার নমস্কার করি।
‘ছড়াছড়ি’ শব্দে তখনকার দিনে প্রচলিত একটু ক্ষুদ্র তাচ্ছিল্য লুকানো রয়েছে। পরমহংসদেব সেটিকেও নমস্কার করেছেন।
রাজা রামমোহন খ্রিস্টধর্মে মহাপণ্ডিত ছিলেন, মুসলমান ধর্মের ‘জবরদস্ত মৌলভি’ ছিলেন এবং সবচেয়ে বড় কথা, সে যুগে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে হলে যে বস্তু সম্পূর্ণ অবান্তর এমনকি অন্তরায়, সেই হিন্দু ধর্ম-শাস্ত্রে তাঁর অসাধারণ পাণ্ডিত্য, অতুলনীয় ব্যুৎপত্তি এবং গভীর অন্তর্দৃষ্টি ছিল।
রাজা জানতেন, সে যুগের হিন্দুকে তর্ক-বিতর্ক করতে হবে খ্রিস্টধর্মের সঙ্গে। অর্থাৎ খ্রিস্টান মিশনারির সামনে ‘ক’ অক্ষরে ‘কৃষ্ণনাম’ স্মরণে ‘একঘটি’(৩) চোখের জল ফেললেই আপন ধর্মের মাহাত্ম্য সুপ্রতিষ্ঠিত হবে না- খুব বেশি হলে, ভদ্র মিশনারি হয়তো তাকে ভক্ত বলে স্বীকার করবে মাত্র। তাই তাকে প্রমাণ করতে হবে যে, কলকাতার হিন্দুর ক্রিয়াকর্মের পিছনে রয়েছে, হিন্দুর ষড়দর্শন, বুদ্ধ এবং মহাবীরের বিশ্বপ্রেম এবং সর্বপশ্চাতে রয়েছে অহরহ জাজ্বল্যমান বেদবেদান্তের অখও দিব্যদৃষ্টি।
দেশের আপামর জনসাধারণের ভিতর হিন্দুধর্মের নব উন্মাদনা আনতে হলে রাজা রামমোহন হিন্দুধর্মের কোন কোন সম্পদ গ্রহণ এবং প্রচার করতেন সেকথা বলা শক্ত; কিন্তু এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে, সে যুগের কলিকাতাবাসী সুসভ্য অথচ আপন শাস্ত্রে অজ্ঞ হিন্দুর সামনে তিনি সর্বশাস্ত্র মন্থন করে উপনিষদগুলোই তুলে ধরে প্রকৃত ঋষির গভীর অন্তদৃষ্টির পরিচয় দিয়েছিলেন। উপনিষদ থেকেই শঙ্কর-দর্শনের সূত্রপাত এবং শঙ্করের অদ্বৈতবাদ অতিশয় অক্লেশে, পরম অবহেলায় খ্রিস্টানের ট্রিনিটিকে সম্মুখ-সংগ্রামে আহ্বান করতে পারে। উপনিষদের গুণকীর্তন এ ক্ষুদ্র এবং অক্ষম রচনার উদ্দেশ্য নহে– অনুসন্ধিৎসু পাঠক তুর্কি পণ্ডিত অলবিরুনি, মোগল সুফি দারাশিকুহ, (ঔরঙ্গজিবের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা)(৪) এবং জর্মন দার্শনিক শোপেনহাওয়ারের রচনাতে তার ভূরি ভূরি উদাহরণ পাবেন।