রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক চিন্তাধারা ইংরেজ পছন্দ করত না বলে শান্তিনিকেতন আশ্রমটিকে নষ্ট করার জন্য ইংরেজ একটি সূক্ষ্ম গুজব বাজারে ছড়ায়– শান্তিনিকেতনের স্কুল আসলে রিফরমেটরি। অন্তত এই আমার বিশ্বাস।
খুব সম্ভব তারই ফলে আশ্রমে মারাঠি ছেলে ভাণ্ডারের উদয়।
স্কুলের মধ্য বিভাগে বীথিকা-ঘরে ভাণ্ডারে সিট পেল। এ ঘরটি এখন আর নেই, তবে ভিতটি স্পষ্ট দেখতে পাওয়া যায়। তারই সমুখ দিয়ে গেছে শালবীথি। তারই একপ্রান্তে লাইব্রেরি, অন্যপ্রান্তে দেহলী। গুরুদেব তখন থাকতেন দেহলীতে।
দেহলী থেকে বেরিয়ে, শালবীথি হয়ে গুরুদেব চলেছেন লাইব্রেরির দিকে। পরনে লম্বা জোব্বা, মাথায় কালো টুপি। ভাণ্ডারে দেখামাত্রই ছুটল তাঁর দিকে। আর সব ছেলেরা অবাক। ছোকরা আশ্রমে এসেছে দশ মিনিট হয় কি না হয়। এরই মধ্যে কাউকে কিছু ভালো-মন্দ না শুধিয়ে ছুটল গুরুদেবের দিকে।
আড়াল থেকে সবাই দেখল ভাণ্ডারে গুরুদেবকে কী যেন একটা বলল। গুরুদেব মৃদুহাস্য করলেন। মনে হল যেন অল্প অল্প আপত্তি জানাচ্ছেন। ভাণ্ডারে চাপ দিচ্ছে। শেষটায় ভাণ্ডারে গুরুদেবের হাতে কী একটা গুঁজে দিল। গুরুদেব আবার মৃদু হাস্য করে জোব্বার নিচে হাত চালিয়ে ভিতরের জেবে সেটি রেখে দিলেন। ভাণ্ডারে একগাল হেসে ডরমিটরিতে ফিরে এল। প্রণাম না, নমস্কার পর্যন্ত না।
সবাই শুধাল, ‘গুরুদেবকে কী দিলি?’
ভাণ্ডারে তার মারাঠি-হিন্দিতে বলল, ‘গুরুদেব কৌন? ওহ তো দরবেশ হৈ।’
‘বলিস কী রে, ও তো গুরুদেব হ্যায়!’
‘ক্যা “গুরুদেব” “গুরুদেব” কর তা হৈ। হম উসকো এক অঠন্নি দিয়া।’
বলে কী? মাথা খারাপ না বদ্ধপাগল? শুরুদেবকে আধুলি দিয়েছে!
জিগ্যেসাবাদ করে জানা গেল, দেশ ছাড়ার সময় ভাণ্ডারের ঠাকুরমা তাকে নাকি উপদেশ দিয়েছেন, সন্ন্যাসী-দরবেশকে দানদক্ষিণা করতে। ভাণ্ডারে তাঁরই কথামতো দরবেশকে একটি আধুলি দিয়েছে। তবে হ্যাঁ, দরবেশ বাবাজি প্রথমটায় একটু আপত্তি জানিয়েছিল বটে, কিন্তু ভাণ্ডারে চালাক ছোকরা, সহজে দমে না, চালাকি নয়, বাবা, এ একটি পুরি অঠন্নি!
চল্লিশ বছরের আগের কথা। অঠন্নি সামান্য পয়সা, একথা কেউ বলেনি। কিন্তু ভাণ্ডারেকে এটা কিছুতেই বোঝানো গেল না যে তার দানের পাত্র দরবেশ নয়, স্বয়ং গুরুদেব।
ভাণ্ডারের ভুল ভাঙতে কতদিন লেগেছিল, আশ্রম পুরাণ এ বিষয়ে নীরব। কিন্তু সেটা এস্থলে অবান্তর।
ইতোমধ্যে ভাণ্ডারে তার স্বরূপ প্রকাশ করেছে। ছেলেরা অস্থির, মাস্টাররা জ্বালাতন, চতুর্দিকে পরিত্রাহি আৰ্তরব।
হেডমাস্টার জগদানন্দবাবু এককালে রবীন্দ্রনাথের জমিদারি-সেরেস্তায় কাজ করেছিলেন। লেঠেল ঠ্যাঙানো ছিল তাঁর প্রধান কর্ম। তিনি পর্যন্ত এই দুঁদে ছেলের সামনে হার মেনে গুরুদেবকে জানালেন।
আশ্রম-স্মৃতি বলেন, গুরুদেব ভাণ্ডারেকে ডেকে পাঠিয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ-রে, ভাণ্ডারে, এ কী কথা শুনি?’
ভাণ্ডারে চুপ।
শুরুদেব নাকি কাতর নয়নে বললেন, ‘হ্যাঁরে ভাণ্ডারে, শেষপর্যন্ত তুই এসব আরম্ভ করলি? তোর মতো ভালো ছেলে আমি আজ পর্যন্ত দেখিনি। আর তুই এখন আরম্ভ করলি
এমন সব জিনিস যার জন্য সক্কলের সামনে আমাকে মাথা নিচু করতে হচ্ছে। মনে আছে, তুই যখন প্রথম এলি তখন কীরকম ভালো ছেলে ছিলি? মনে নেই, তুই দান-খয়রাত পর্যন্ত করতিস? আমাকে পর্যন্ত তুই একটি পুরো আধুলি দিয়েছিলি? আজ পর্যন্ত কত ছাত্র এল-গেল, কেউ আমাকে একটি পয়সা পর্যন্ত দেয়নি। সেই আধুলিটি আমি কত যত্নে তুলে রেখেছি। দেখবি?’
***
তার দু এক বৎসরের পর আমি শান্তিনিকেতনে আসি। মারাঠি সঙ্গীতজ্ঞ স্বর্গীয় ভীমরাও শাস্ত্রী তখন সকালবেলার বৈতালিক লিড করতেন। তার কিছুদিন পর শ্ৰীযুত অনাদি দস্তিদার। তার পর ভাণ্ডারে।
চল্লিশ বছর হয়ে গিয়েছে। এখনও যেন দেখতে পাই ছোকরা ভাণ্ডারে বৈতালিকে গাইছে,
এ দিন আজি কোন ঘরে গো
খুলে দিল দ্বার।
আজি প্ৰাতে সূর্য ওঠা
সফল হল কার ॥
শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব
ধর্মের ইতিহাসে দেখা যায়, কোনও সভ্য জাতির বিত্তশালী সম্ভ্রান্ত সম্প্রদায়ের মাতৃভাষা কিংবা অন্য কোনও বোধ্য ভাষাতে যদি ধর্মচর্চা না থাকে তবে সে সম্প্রদায় ক্রিয়া-কর্ম ও পাল-পার্বণ নিয়েই মত্ত থাকে! এই তত্ত্বটি ভারতবাসীর ক্ষেত্রে অধিকতর প্রযোজ্য। কারণ, তারা স্বভাবত এবং ঐতিহ্যবশত ধর্মানুরাগী। তার কোনও বোধ্য ভাষাতে সত্যধর্মের মূলস্বরূপ সম্বন্ধে কোনও নির্দেশ না থাকলে সে তখন সবকিছু হারাবার ভয়ে ধর্মের বহিরাচরণ অর্থাৎ তার খোলস ক্রিয়াকর্মকেই আঁকড়ে ধরে থাকে।(১)
কলকাতা অর্বাচীন শহর। যেসব হিন্দু এ শহরের গোড়াপত্তনকালে ইংরেজের সাহায্য করে বিত্তশালী হন, তাঁদের ভিতর সংস্কৃত ভাষার কোনও চর্চা ছিল না। বাঙলা গদ্য তখনও জন্মলাভ করেনি। কাজেই মাতৃভাষার মাধ্যমে যে তাঁরা সত্যধর্মের সন্ধান পাবেন তারও কোনও উপায় ছিল না। ওদিকে আবার বাঙালি ধর্মপ্রাণ। তাই সে তখন কলকাতা শহরে পাল-পার্বণে যা সমারোহ করল তা দেখে অধিকতর বিত্তশালী শাসক ইংরেজ-সম্প্রদায় পর্যন্ত স্তম্ভিত হল। এর শেষ-রেশ ‘হুতোমে’ পাওয়া যায়।
জাতির উত্থান-পতনেও এ অবস্থা বারবার ঘটে থাকে। এবং সমগ্রভাবে বিচার করতে গেলে তাতে করে জাতির বিশেষ কোনও ক্ষতি হয় না। গরিব-দুঃখীর তথা সমগ্র সমাজের জন্য এর একটা অর্থনৈতিক মূল্য তো আছে বটেই, তদুপরি এক যুগের অত্যধিক পাল-পার্বণের মোহকে পরবর্তী যুগের ঐকান্তিক ধ্যান-ধারণা অনেকখানি ক্ষতিপূরণ করে দেয়।