তাই এই প্রবন্ধের নাম দিয়েছি ‘মামদো’র পুনর্জন্ম। ‘মামদো’রই যখন কোনও অস্তিত্ব নেই, তখন তার পুনর্জন্ম হবে কী প্রকারে? পুর্ব বাঙলার লেখকদের স্কন্ধে আরবি-ফারসি শব্দের মামদো ভর করবে, আর তারা বাহ্যজ্ঞানশূন্য হয়ে আরবি-ফারসিতে অর্থাৎ ‘যাবনী মেশালে’ কিচিরমিচির করতে আরম্ভ করবে, বিজাতীয় সাহিত্য সৃষ্টি করবে– যার মাথামুণ্ডু পশ্চিম বাঙলার লোক বুঝতে পারবে না, সে ভয় ‘স্বপ্ন, মায়া, মতিভ্রম’।
রবি-পুরাণ
রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনে প্রচুর বক্তৃতা প্রচুরতর প্রবন্ধ এবং অল্প-বিস্তর বেতার কার্যকলাপের ব্যবস্থা এদেশের গুণী-জ্ঞানীরা করে থাকেন। সেই অবসরে কেউ কেউ আমাকেও স্মরণ করেন। আপাতদৃষ্টিতে মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয় যে এঁরা আমার কল্যাণ কামনা করেন; সরল জনের পক্ষে অনুমান করা অসম্ভব নয় যে এই করে হয়তো দেশে আমার নামটা কিঞ্চিৎ ছড়িয়ে পড়বে। কিন্তু আসলে যারা আমাকে স্মরণ করেন তাঁরা আমার প্রাণের বৈরী। এঁরা আমাকে সর্বজনসমক্ষে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বলতে চান, ‘দেখো, এ লোকটা কত বড় গণ্ডমূর্খ; কবিগুরুর সংস্পর্শে এসেও এর কিছু হল না।’ সাধে কি আর তুলসীদাস রামচরিতমানসে বলেছেন,
‘মূরখ হৃদয় ন চেৎ, যদপি মিলয়ে
গুরু বিরিঞ্চি শত’
‘শত ব্রহ্মা গুরুপদ নিলেও মূর্খের ক
হৃদয়ে চেতনা হয় না’
আমি মূর্খ হতে পারি কিন্তু এতখানি মূর্খ নই যে তাঁদের দুষ্টবুদ্ধিজাত নষ্টামির চিন্তা ধরতে পারব না।
তাই ওই সময়টায় আমি গা-ঢাকা দিয়ে থাকি। নিতান্ত কারও সঙ্গে দেখা হলে বলি, এনৃজাইনা থ্রম্বোসিস হয়েছে। এনজাইনা পিক্টরিস কিংবা করোনারি থ্রম্বোসিস-এর যে-কোনও একটার নাম শুনলেই সুস্থ মানুষের হৃৎপিণ্ড বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম করে– আমার ওই দ্বন্দ্বসমাস শুনে আমাকে তখন আর কেউ বড় একটা ঘ্যাঁটায় না।
অথচ রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে দু একটি কথা বলবার সাধ যে আমার হয় না, তা-ও নয়। অবশ্য তাঁর কাব্য, নাট্য কিংবা জীবনদর্শন সম্বন্ধে নয়। অতখানি কাণ্ডজ্ঞান বা কমনসেনস্ আমার আছে। আমার বলতে ইচ্ছে করে সেই জিনিস, ইংরেজিতে যাকে বলে লাইটার সাইড। এই যেমন মনে করুন, তিনি গল্পগুজব করতে ভালোবাসতেন কি না, প্রিয়জনের সঙ্গে হাস্যপরিহাস করতেন কি না, ডাইনিঙ-রুমে বসে চেয়ার টেবিলে ছুরিকাঁটা দিয়ে ছিমছামভাবে সায়েবি কায়দায় খেতেন, না রান্নাঘরের বারান্দায় হাপুস-হুঁপুস শব্দে মাদ্রাজি স্টাইলে পাড়া সচকিত করে পর্বটি সমাধান করে সর্বশেষে কাবুলি কায়দায় ঘোঁতঘোঁত করে ঢেঁকুর তুলতে তুলতে বাঙালি কায়দায় চটি ফটফটিয়ে খড়কের সন্ধানে বেরোতেন? কেউ তাঁকে প্রেমপত্র লিখলে তিনি কী করতেন? কিংবা ডিহি শ্রীরামপুর দুই নম্বর বাই লেন তাদের কম্বল বিতরণী সভায় তাঁকে প্রধান অতিথি করার জন্য ঝুলাঝুলি লাগালে তিনি সেটা এড়াবার জন্য কোন পন্থা অবলম্বন করতেন? কিংবা কেউ টাকা ধার চাইলে?
ভালোই হল টাকা ধারের কথা মনে পড়ল।
‘দেহলী’র উপরে থাকতেন তিনি, নিচের তলায় তাঁর নাতি দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ওরফে দিনুবাবু।
তাঁরই বারান্দায় বসে আশ-কথা-পাশ-কথা নানা কথা হচ্ছে। হতে হতে টাকা ধার নেওয়ার কথা উঠল। হঠাৎ রবীন্দ্রনাথ বললেন, ‘বুঝলি দিনু, আমার কাছ থেকে একবার একজন লোক দশ টাকা ধার নিয়ে গদগদ কণ্ঠে বলল, আপনার কাছে আমি চিরঋণী হয়ে রইলুম।’ সভায় যারা ছিলেন তাঁরা পয়েন্টটা ঠিক কী বুঝতে না পেরে চুপ করে রইলেন। আফটার অল, গুরুদেবের পক্ষেও কালে-কম্মিনে কাঁচা রসিকতা করা অসম্ভব না-ও হতে পারে।
খানিকক্ষণ পরে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে শুরুদেব বললেন, ‘লোকটার শত-দোষ থাকলেও একটা গুণ ছিল। লোকটা সত্যভাষী! কথা ঠিক রেখেছিল। চিরঋণী হয়েই রইল।’
শ্ৰীযুত বিধুশেখর শাস্ত্রী, নেপালচন্দ্র রায় ইত্যাদি মুরুব্বিরা অট্টহাস্য করেছিলেন। আমরা, অর্থাৎ চ্যাংড়ারা, থামের আড়ালে ফিকফিক করেছিলুম।
এ গল্পটি আমি একাধিক লোকের মারফত পরেও শুনেছি। হয়তো তিনি গল্পটি একাধিক সভা-মজলিসে বলেছেন। এবং গল্পটি আদৌ তার নিজের বানানো না অন্যের কাছ থেকে ধার-নেওয়া সেকথাও হলফ করে বলতে পারব না। কারণ কাব্যানুশাসনের টীকা লিখতে গিয়ে আলঙ্কারিক হেমচন্দ্র বলেছেন, ‘নাস্ত্য চৌরঃ কবিজন নাস্ত্য চৌরো বণিকজনঃ;–অর্থাৎ ‘বড় বিদ্যাটি বিলক্ষণ রপ্ত আছে স্যাকরার এবং কবি মাত্রেরই।’
তা হোক। মহাকবি হাইনরি হাইনে তাতে কণামাত্র আপত্তি না তুলে বলেছেন, ‘যারা কবির রচনাতে “নির্ভেজাল” অরিজিনালিটি খোঁজে তারা চিবাক মাকড়ের জাল, কারণ একমাত্র মাকড়ই তার জালটি তৈরি করে আপন পেটের মাল দিয়ে, মোল আনা অরিজিনাল; আমি কিন্তু খেতে ভালোবাসি মধু, যদিও বেশ ভালোভাবেই জানি মধুভাণ্ডের প্রতিটি ফোঁটা ফুলের কাছ থেকে চোরাই করা মাল।’
কিন্তু রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে প্রচলিত গল্পের ভিতর আমার সবচেয়ে ভালো লাগে ‘গুরুদেব-ভাণ্ডারে’ কাহিনী! অবশ্য আমার মনে হয়, গল্পটির নাম ‘ভাণ্ডারে গুরুদেব’ কাহিনী দিলে ভালো হয়, কারণ কাহিনীটি সম্পূর্ণ নির্ভর করছে, ভাণ্ডারের একটি সৎকর্মের ওপর। তুলনা দিয়ে বলতে পারি, অধ্যাপক সত্যেন্দ্রনাথ বসু যখন তাঁর বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার জগজ্জন সম্মুখে প্রকাশ করলেন তখন কালা আদমির কেরানি বরদাস্ত না করতে পেরে ইংরেজ আবিষ্কারটার নামকরণ করল ‘আইনস্টাইন-বোস থিয়রি’। স্বয়ং আইনস্টাইন তখন নাকি প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছিলেন, ওটার নাম হয় হবে শুধুমাত্র ‘বোস থিয়রি’ নয় ‘বোস-আইনস্টাইন থিয়রি’। এসব অবশ্য আমাদের শোনা কথা। ভুল হলে পুজোর বাজারের বিলাস বলে ধরে নেবেন।